এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ::
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ মংডু কাউয়ারবিল এলাকায় সে দেশের পুলিশ পোস্টে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে একটি বিশেষ মহল আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটানোর অপতৎপরতা শুরু করেছে। ওই হামলায় মংডু কাউয়ার বিল, ট্যানাই সুট ও নাকফুরা ঘাঁটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে। রবিবার রাতে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্র“ বরাবর মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) ঘাঁটি থেকে ১০-১২রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে বলে ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইশেন (আরএসও) এবং জামায়াত-বিএনপির কতিপয় নেতা গোপনে একাট্টা হয়ে সীমান্ত পরিস্থিতি ঘোলাটে করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ঘাপটি মেরে থাকা আরএসও জঙ্গী নেতারা মিয়ানমারে বসবাসকারী নীরিহ রোহিঙ্গা মুসলিমদের এদেশে পালিয়ে আসতে উস্কানি দিচ্ছে। আর এ কাজে জামায়াত-বিএনপির কতিপয় নেতা মদদ যুগাচ্ছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার ও নজরদারী বৃদ্ধি করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। বাংলাদেশের সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বিজিবি।
সূত্র জানায়, সোমবার সকালে সার্ট প্যান্ট পরিহিত মৌলভী শফিক (দাড়ি বিহীন) নামে এক আরএসও নেতা ছদ্মবেশে প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর ও রোহিঙ্গা মাঝিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তার মুঠোফোন থেকে আরএসও নেতা মাষ্টার আয়ুব ও মৌলভী নুর হোসেনের পরামর্শ শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝিদের সঙ্গে শেয়ার করে শুনিয়ে দিয়েছে। তবে কী আলোচনা হয়েছে, জানা না গেলেও মিয়ানমারের অবস্থানকারী স্বজনদের সঙ্গে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মুঠোফোনে হরদম যোগাযোগ করে চলছে বলে জানা গেছে। এদিকে রবিবার থেকে টেকনাফ-মংডু রুটে চলাচলকারী ট্রানজিটধারী যাত্রীবাহী সকল প্রকার বোট ও ট্রলার বন্ধ রয়েছে। বিজিবি টেকনাফ সদর বিওপির আওতায় একদিনের (৮ঘন্টা) জন্য মিয়ানমারে যাওয়া-আসা ট্রানজিট ঘাটও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত দুইদিনে টেকনাফ স্থলবন্দরে ভিড়েনি মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী কোন জাহাজ। বিজিবির উদ্যোগে মাইকিং করে জেলেদের নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও বাংলাদেশ সীমান্তে কোন ধরণের উত্তেজনা ও আতঙ্ক নেই।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জনকণ্ঠকে জানান, রবিবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মিয়ানমারের তুমব্র“ ঘাটির সীমান্তরক্ষী (পুলিশ) অহেতুক থেমে থেমে অন্তত ১০-১২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েছে। সীমান্ত এলাকা ঘুমধুম ও তুমব্র“তে কোন ধরণের আতঙ্ক নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সীমান্ত এলাকায় কাউকে না যেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কক্সবাজার বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্ণেল মো: ইমরান উল্লাহ সরকার জনকণ্ঠকে জানান, সীমান্ত দিয়ে যেন কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশ করতে না পারে- সেদিকে নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে অহেতুক কোন লোকজন চলাচল না করার জন্য সীমান্তে বসবাসকারী সবাইকে অবহিত করা হয়েছে। তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি বর্ষণ সত্য নয় দাবী করে তিনি আরও জানান, তুমব্রু সীমান্ত থেকে প্রায় ৪৭কি.মিটার দূরে মিয়ানমার অভ্যন্তরে অজ্ঞাতনামা গোষ্ঠী মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (পুলিশ) ক্যাম্পের উপর হামলা চালানো ঘটনার পর অতিরিক্ত সতর্কতা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষাসহ অনুপ্রবেশ রোধকল্পে বিজিবি সদস্যরা নিরলস দায়িত্ব পালন করছে। এদিকে আরাকান রাজ্যের সীমান্তরক্ষীরা এ হামলার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন আরএসও’কে দায়ী করেছেন। তবে আরএসও’র একটি সূত্রের দাবী হচ্ছে- মিয়ানমারের ঘাঁটিতে কথিত হামলা ও অস্ত্র লুট সাজানো ঘটনা। আরএসও একটি গ্রুপের প্রধান মাষ্টার আয়ুবের আস্থাভাজন রোহিঙ্গা মৌলভী নুর হোসেন জানান, একটি ঘটনার ইস্যু সৃষ্টি করে মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমকে তাদের নাভীছেড়া দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের এটি একটি অপকৌশল মাত্র। ২০১২ সালেও সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গায় ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করেছিল দেশটির সামরিক জান্তা। ওইসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশ ত্যাগ করে মালয়েশিয়া পালিয়ে যায়।
সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া অসমর্থিত একাধিক সূত্রে জানা যায়, সশস্ত্র হামলার পরপরই মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে। চলানো হচ্ছে ব্যাপক ধরপাকড়। শুরু হয়েছে রাখাইন এলাকায় দফায় দফায় দাঙ্গা হাঙ্গামা। এতে বহু লোক নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে দেশটির সেনাবাহিনী মোতায়েন সহ টহল দিচ্ছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বিজিবি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ সহ বাড়তি নিরাপত্তা ও অতিরিক্ত সতর্কাবস্থায় টহল জোরদার করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ শরণার্থীরা জানায়, আমরা এদেশে আশ্রিত হয়ে শরণার্থী হিসেবে নিরাপদে বাস করছি। তবে আরএসও নেতা মাষ্টার আয়ুব, মৌলভী নুর হোসেন, আবু বক্কর, মৌলভী শফিক, ড. ইউনুছের সহোদর আবু তাহের, মেয়ের জামাই মো: ইউনুছ, মৌলভী মো: সেলিম ওরফে আবু আবদুল্লাহ ও রুহুল আমিনদের কারণে এদেশ ওদেশ (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) কোথাও শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না। ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আরএসও ক্যাডাররা কোন দেশের জন্য নিরাপদ নয় বলে জানায় রোহিঙ্গারা। টেকনাফ থানায় আরএসও নেতা মাষ্টার আয়ুব ও আবু বক্করসহ ৬ রোহিঙ্গা জঙ্গীর নাম উল্লেখ করে ১১ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ বিজিবি মামলা দায়ের করলেও পুলিশ এ পর্যন্ত পলাতক আসামিদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
অপরদিকে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের এদেশে আনার জন্য জামায়াত ও আরএসও’র পক্ষে বিরাট দালাল চক্র সব সময় নানাভাবে তৈরি থাকে সীমান্ত এলাকায়। এই চক্রের মধ্যে ৫১ রোহিঙ্গা বান্ধব জনপ্রতিনিধিও রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ওই চক্রের হাতে রয়েছে অর্থ আর পেশী শক্তি। রোহিঙ্গাদের দেশে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করতে এ দু’টি শক্তিই নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাবেক মহা সচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সফর করলেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। একাধিক সীমান্ত এলাকা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে রোহিঙ্গারা এসে মিশে যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। এদের অনেকেই যোগ দিচ্ছে জঙ্গী কার্যক্রমে। তারা টাকার বিনিময়ে যে কোন অপরাধ করেই চলেছে। বিশেষ করে জামায়াত তাদের সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
কক্সবাজারের ডিসি মো: আলী হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ১৩৪ কিলোমিটার সীমান্ত অঞ্চলে কাঁটা তারের বেড়া দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর দফতর অনুমোদন দিয়েছে। এখন এই কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আমরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ‘জিরো লেভেলে’ নিয়ে আসার জন্য কাজ করছি। বিজিবি সার্বক্ষণিক সীমান্ত এলাকায় টহলে রয়েছে। যাতে করে কোন অনুপ্রবেশকারী সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সব সেক্টর কাজ করে যাচ্ছে। একজন রোহিঙ্গাও যাতে অনুপ্রবেশ না করতে পারে-তার জন্য যা করা দরকার তাই করা হবে।
মিয়ানমারে জরুরী অবস্থা জারি ॥ মিয়ানমারের মংডু এলাকার ট্যানাইসুট, কাউয়ারবিল ও নাকফুরা এলাকায় তিনটি বিজিপি ক্যাম্পে অস্ত্র লুট ও নিহতের ঘটনায় জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিহতের ছবি প্রকাশ পেয়েছে। তবে মিয়ানমার সরকারীভাবে এখনও হামলাকারী গোষ্ঠী আরএসও বলে দাবী করছে। হামলার পর থেকে মংডুসহ আরাকান রাজ্যে সন্ধ্যা ৭টা হতে ভোর ৬টা পর্যন্ত জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে।
সুত্র, জনকন্ঠ