কালের কন্ঠ
ডিজেল বিক্রিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কাটাতে সরকার অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়িয়েছে। দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর ৭৩ শতাংশই ডিজেলে পূরণ হয়। গত শুক্রবার রাতে প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পরও প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে বিপিসির লোকসান গুনতে হচ্ছে আট টাকা ২৩ পয়সা করে। এক মাসে এই লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। এই লোকসান সমন্ব্বয় করতেই অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে অকটেন লিটারে ৮৯ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। এতে প্রতি লিটার অকটেন বিক্রিতে বিপিসির লাভ হবে ৪৬ টাকা। এই হিসাবে মাসে লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫৭ কোটি টাকা। পেট্রল লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। এতে মাসে লাভ হবে ৭৪ লাখ টাকা। বিপিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য পুরোপুরি দূর করতেই রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি তেলে সরকার ভর্তুকি না দেওয়ার নীতিতে যাওয়ার পদক্ষেপ এটি।
এদিকে গতকাল শনিবার দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বিপিসির লোকসান কমানোসহ পাশের দেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর পরও প্রতি লিটার ডিজেলে লোকসান হচ্ছে আট টাকা ১৩ পয়সা। নতুন দর নির্ধারণ করার পরও জুলাই মাসের ডিজেল বিক্রির পরিমাণ অনুযায়ী এখন মাসে ডিজেল বিক্রিতে আমাদের লোকসান হবে ১৩০ কোটি টাকা। তবে অকটেন বিক্রিতে মাসে লাভ হবে প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা। আর পেট্রল বিক্রিতে মাসে লাভ আসবে ৭৪ লাখ টাকা। ’
বিপিসির চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘ডিজেল প্রান্তিক মানুষ ব্যবহার করে, তাই আমরা এটি লিটারে আট টাকা ১৩ পয়সা করে লোকসান দিয়ে বিক্রি করছি। কিন্তু অকটেন ও পেট্রল মূলত সামর্থ্যবানরাই ব্যবহার করছে। তাই ডিজেলের সঙ্গে অকটেন ও পেট্রলের দামও সমন্বয় করা হয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘পাশের দেশের জ্বালানি তেলের মূল্যের সঙ্গে আমাদের বিরাট পার্থক্য, সেটাও দূর করা মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ। গত বছরের একই সময়ে যে পরিমাণ ডিজেল বিক্রি হয়েছিল, সেই তুলনায় বর্তমানে দৈনিক দুই হাজার মেট্রিক টন বেশি ডিজেল বিক্রি হচ্ছিল। এটি ডিজেল পাচারের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ’
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘ডিজেলের লোকসান সমন্বয় করতেই অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ানো হয়েছে। পেট্রলের দাম বাড়ানোর আরেকটি কারণ হচ্ছে, অকটেনের ভেজাল বন্ধ করা। ’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে জ্বালানি তেলে আর ভর্তুকি দেওয়া হবে না, এমন নীতিতে চলে গেছে সরকার। যে হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাতে শুধু ভর্তুকি বন্ধ হবে না, তেল বিক্রিতে বিপিসির লাভও হবে। ’ তিনি বলেন, ‘হুট করে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি আমরা আশা করিনি। এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। গতবার লিটারপ্রতি ১৫ টাকার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে যে পরিমাণ মূল্যস্ফীতি দেখেছি, তাতে আমার ধারণা সামনে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতির দিকে এগোচ্ছি আমরা। ’ তিনি আরো বলেন, ‘জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পরিবহনের ভাড়া বাড়ার আগেই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি পুনর্বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। ’
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বিপিসি বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে আট হাজার ১৪ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, এর আগে গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ায়নি সরকার।
বিশ্ববাজারে দাম কমছে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। এক পর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম উঠে যায় ১৩৯ ডলারে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সুখবর রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই কমছে জ্বালানি তেলের দাম। গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে।
অয়েল প্রাইস ডটকম বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলই এখন প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কমে বিক্রি হচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল প্রতি ব্যারেল ৭৪.০৪ ও অকটেন ৮৪.৮৪ মার্কিন ডলারে নেমে এলে ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার যথাক্রমে ৮০ ও ৮৯ টাকায় বিক্রি সম্ভব হতো, যা এখন প্রায় অসম্ভব।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘যেহেতু বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে, আশা করছি সামনে আরো কমে আসবে। তাই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত ছিল।