রাজধানীর মতিঝিল এলাকার চারটি স্কুলের ৭ শিক্ষকসহ মোট ১৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাধ্যমিক পরীক্ষার (এসএসসি) প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জ্ঞানকোষ একাডেমি নামে একটি কোচিং সেন্টারের আড়ালে অসাধু শিক্ষকসহ অন্যরা মিলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। আদালত ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কয়েক বছর ধরে নানা উপায়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার গণিতের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার দিন সকালেই ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঢাকা বোর্ডের পক্ষ থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় যে পরীক্ষা শুরুর আগেভাগে শিক্ষকের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। সমালোচনার মুখে ওই পরীক্ষা বাতিল করা না হলেও মন্ত্রণালয় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের আন্তরিক সহায়তা চায়।
ইতিমধ্যে পুলিশ প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতিঝিলকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেটের প্রায় সবাইকে চিহ্নিত করেছে। ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯ আসামি। তাঁদের জবানবন্দি ও জিজ্ঞাসাবাদে আরও ১০ জনের নাম এসেছে এবং তাঁদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে বলে তদন্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দুই শিক্ষকের জবানবন্দি এবং পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছার পরপরই মোবাইল ফোনে ছবি তোলা হয়। এরপর তাঁরা ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে পাঠাতেন। প্রশ্ন অনুযায়ী জবাব তৈরি করে আবারও তা অসাধু শিক্ষকদের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মূলত দুটি প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস হয়। একটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে এবং এই প্রক্রিয়ায় আসল ও ভুয়া—দুই ধরনের প্রশ্ন কেনাবেচা হয়। অপর প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া। মতিঝিলকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট মূলত অল্প সময়ে প্রশ্ন কেনাবেচা করে আসছে। এই প্রক্রিয়া আঁচ করতে পেরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রসচিবসহ পরিদর্শকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কেবল কেন্দ্রসচিবকে সাধারণ একটি ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, শিক্ষকসহ কোচিং সেন্টারের সদস্যরাই প্রশ্নপত্র সংগ্রহ, বিতরণ ও অর্থ লেনদেনের কাজগুলো করতেন। পুলিশের তদন্তে জ্ঞানকোষ একাডেমির নাম এসেছে, যেটিকে কেন্দ্র করে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ওই কোচিং সেন্টারের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে ১ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক, বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার তাবুলপাড়া গ্রামে। মামলার এজাহারে বয়স উল্লেখ আছে ৪৫ বছর।
গতকাল শুক্রবার জ্ঞানকোষ একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায়, এটির মূল ফটক তালাবদ্ধ। মতিঝিল থানার দক্ষিণ কমলাপুরের পাঁচতলা ভবনের নিচের দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে রফিক মাস্টার কোচিং সেন্টারটি চালান। কমলাপুর শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়ের খুব কাছেই এর অবস্থান। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে এটা বেশ পরিচিত।
ওই বাড়ির মালিক বেলাল হোসেন বলেন, রফিক মাস্টারের কোচিংয়ে অনেক শিক্ষার্থী পড়তে আসত। তাঁদের সামনেই জহিরুলকে কোচিং সেন্টার থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
এদিকে পুলিশ নিশ্চিত করেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলেন রফিক। তাঁর নেতৃত্বেই পাঁচ বছর ধরে রাজধানীর ওই চারটি স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক এসএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন। আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন।
এই চক্রের আরেক সদস্য হলেন জহিরুল ইসলাম শুভ। তিনি জ্ঞানকোষ একাডেমির শিক্ষক। তাঁকেও রফিকুলের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে জমা হওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, জহিরুল প্রশ্ন পাওয়ার পর দ্রুত জবাব লিখে সিন্ডিকেটের অপর সদস্যদের কাছে পাঠাতেন।
আদালত ও পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে মতিঝিল এলাকার চারটি বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জড়িত। বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয় ও শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়।
রফিকুল ও জহিরুল জবানবন্দিতে এই চারটি স্কুলের অসাধু শিক্ষকদের নাম ফাঁস করেছেন। তাঁদের জবানবন্দি অনুযায়ী ৭ মার্চ শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আলিম গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তিনি পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন।
আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, আসামি রফিকুলের সহায়তায় শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আলিম কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র কমলাপুর শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আসার পর আফজাল নামে এক ব্যক্তি ছবি তুলতেন। তিনি রফিকুল ও জহিরুলের কাছে তা পাঠাতেন। পরে তাঁরা প্রশ্নের জবাব তৈরি করে অসাধু শিক্ষকদের কাছে পাঠাতেন এবং নানা উপায়ে তা অন্য শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হতো।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য হচ্ছে, পুলিশ ও গোয়েন্দারা সব রকম চেষ্টা করছে। আমরাও তাদের সহায়তা করছি। সরকারি যেসব শিক্ষক জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) বাতিল করা হবে।’
মামলার আসামি ১২
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পুলিশ ১ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা হয়েছে। আসামি করা হয় ১২ জনকে। তাঁরা হলেন জ্ঞানকোষ একাডেমির শিক্ষক জহিরুল ইসলাম, কমলাপুর শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, লিটন আলী, তারিকুজ্জামান হিমেল, আরিফুল ইসলাম, রুমন হোসেন, রাজিব আলী, ইয়াছিন আরাফাত, আফজাল মিয়াজী, হিমেল শিশির, আসিফ ও রায়হান দুর্জয়। তাঁদের মধ্যে আফজাল, হিমেল, আসিফ ও রায়হান ছাড়া বাকি আটজন কারাগারে আছেন। তাঁদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন রফিকুল ও আবদুল আলিম। আবদুল আলিমের নাম এজাহারে ছিল না। ওই দুজনের স্বীকারোক্তিতে আরও কমপক্ষে ছয় শিক্ষকের নাম এসেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত মানববন্ধন অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমরা এমন একটি পরিবেশের মধ্যে আছি, যা আমরা সব খুলে বলতেও পারি না, সহ্যও করতে পারি না। কিন্তু আমরা আর সহ্য করব না। সত্যিকার অর্থে আমাদের মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক বেশি দরকার।’
ফেসবুকে বিজ্ঞাপন
আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, ফেসবুকে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়—এমন বিজ্ঞাপন দিতেন আসামিরা। পরে বিভিন্ন চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র আদান-প্রদান করা হতো। মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষাকেন্দ্রের অসাধু শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশ্নের ছবি পেতেন রফিকুল ইসলাম। পরে তিনি পাঠাতেন তাঁর কোচিং সেন্টারের শিক্ষক জহিরুলের কাছে। জহিরুল প্রশ্নের সমাধান করে প্রশ্নপত্র ও সমাধানের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করতেন। আসামি তারিকুজ্জামান, আরিফুল ইসলাম ও রুমন হোসেন ফেসবুকের চ্যাট গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করতেন। ওই অ্যাডমিনের নাম অ্যাডমিন প্যানেল বিডি।
আসামি আরিফের সঙ্গে জ্ঞানকোষ কোচিংয়ের শিক্ষক জহিরুলের পরিচয় ফেসবুকে। সেই সুবাদে তাঁরা ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলার স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতেন। আসামিরা বিভিন্ন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রি করে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে একাধিক ধাপে টাকা তুলেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো ছাড় দেবে না। যাঁদের নামই আসুক, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যাঁদের নাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসেছে, পুলিশ তাঁদেরও আসামি করতে পারে।
পাঠকের মতামত