নিউজ ডেস্ক::
ইয়াবা খেলে জীবন শেষ। প্রথমে সাময়িক শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হলেও শরীরে ক্ষতি শুরু হতেই থাকে। খাওয়া মাত্রই শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে গিয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তিন মাস পরই দৃশ্যমান অসুস্থতা ধরা পড়ে। মহিলারা মাথায় উকুন হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে। সন্তান ধারণ ক্ষমতা ও যৌন সম্পর্ক স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ব্রেনের ভেতরে ডোপামিন নিঃসরণ ঘটে। ফুসফুসে পানি জমে যায়, পরবর্তীতে ক্যান্সার হয়। হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, ইয়াবার আগ্রাসীতে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিষ্ঠুর নির্মম হয়ে যায়। ইয়াবা আসক্তরা এমন পাষণ্ড হয়ে যায় যে, পিতা-মাতা সন্তানদেরও হত্যা করতে তাদের অনুশোচনা হয় না। গতকালই রাজধানীর দক্ষিণখানে ইয়াবা আসক্ত ছেলের হাতে মা খুন হয়েছে এবং চাঁদপুরে ছেলের হাতে বাবা খুন হয়েছেন। আমাদের ব্রেনের ফ্রন্টাল একটি লোপে যেখানে বিচার বিবেচনার বোধ তৈরি হয়, যেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, পরিকল্পনা করি সে জায়গাটা কাজ করতে পারে না। ফলে মানুষ পাষণ্ড হয়ে যায়, হিংস হয়ে যায়। মায়ের গলায় ছুরি ধরে টাকার জন্য, মা বাবার বুকে বসে ছুরি চালাতে ইয়াবা আসক্তদের বুকও কাঁপে না। আশেপাশের আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথেও সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। মাংসপেশি শুকিয়ে গেলে একটু শুকনা মনে হয়, গাল ভেঙে যায়। ইয়াবায় শারীরিক, সামাজিক ও মানসিকসহ সবক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর ক্ষতি থাকলেও বাংলাদেশে এখনো ৭৭ লাখ মানুষ এই ক্রেজি ট্রাগে আসক্ত। তারা এখন মৃত্যুর ঝুঁকিতে। ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে ৬০ ভাগ তরুণ। শিগগিরই ইয়াবা সেবন থেকে বিরত না থালে তাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা হচ্ছে এটম বোমার চেয়ে ক্ষতিকর। এটা মানুষের শরীরকে একেবারে শেষ করে দেয়।
তবে ইয়াবা খেলে কিছু সুবিধা মনে হতে পারে। যেমন সাময়িকভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়। শরীরে উত্তেজনা আসে, ফলে ঠিকমতো ঘুম হয় না, এক নাগাড়ে দুই তিনদিনও না ঘুমিয়ে জেগে থাকা যায়। মনে করে ভীষণ কাজ কর্ম করা যাবে, কিন্তু আসলে কোন কাজই হয় না। প্রাথমিকভাবে যৌন উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। আসক্ত শিক্ষার্থীরা সারা রাত ধরে একটা পাতাও উল্টাতে পারে না, এক পাতাতেই বসে থাকে। প্রচলিত ভুল তথ্য আছে যে, ইয়াবা খেয়ে শিক্ষার্থীরা রাতে বেশিক্ষণ জেগে থেকে পড়তে পারে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, জেগে থাকলেও কোন লাভ হয় না। কারণ পড়ালেখায় আসক্ত শিক্ষার্থীর মনোযোগ থাকে না। মোটা মানুষকে ইয়াবা চিকনও করে না। এটা খেলে তার খিদে কমে যায়। তখন সে কম খায়। তার পেশীকে ক্ষয় করে ফেলে। মাংসপেশি শুকিয়ে গেলে একটু শুকনা মনে হয়, গাল ভেঙে যায়। কিন্তু চিকন হওয়ার তথ্য পুরোপুরি ভুল বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ইয়াবা আসক্ত নারীদের মুরগির মাংস দেখলে মনে হয় তার ভেতরে অনেক কেঁচো। মাথার চামড়াকে মনে হবে লাল রক্ত।
হেরোইনের মতো করেই খেতে হয় ইয়াবা। এলোমুনিয়ামের ফয়েলের উপর ইয়াবা ট্যাবলেট রেখে নিচ থেকে তাপ দিয়ে ওটাকে গলাতে হয়। তখন সেখান থেকে যে ধোঁয়া বের হয় সেটা একটা নলের মাধ্যমে মুখ দিয়ে গ্রহণ করা হয়। তখন সেটা মুহূর্তের মধ্যেই সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রে গিয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেনটাল হেলথের সাইকোথেরাপির অধ্যাপক বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. মোহিত কামাল ইত্তেফাককে জানান, এখন সব পেশার মানুষ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত। ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো নির্মূল অভিযান চলছে। যদি এই মাদক যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহলে ইয়াবার কাছে পরাজিত হবো। ইয়াবায় দেশ ভেসে যাবে। মাদক ব্যবসায়ীরা উত্সাহিত হবে। তাই পিছু হটা যাবে না। পিছু হটলে পুরো জাতি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইয়াবায় আসক্তদের নিষ্ঠুর করে তোলে। তখন সে খুন করতে পিছপা হয় না। এটা এটম বোমার চেয়ে ক্ষতিকর। মাদকের বিরুদ্ধে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। মোহিত কামাল বলেন, ইয়াবা খেলে মস্তিষ্কের সরু রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তপাতও হওয়ার ঘটনাও আমরা পেয়েছি। ব্রেইন ম্যাটার সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সেটা যদি ১৫০০ গ্রাম থাকে সেটা শুকিয়ে এক হাজার গ্রামের নিচে নেমে যেতে পারে। জেনেটিক মলিকিউলকেও নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মও স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে থাকে।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, ইয়াবা এমন ক্ষতিকর মাদক যে, আসক্তদের হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে সেগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত করে। গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। আস্তে আস্তে শরীর শেষ করে দেয়। চিকিৎসা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কাজ হয় না। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এন হুদা জানান, ইয়াবায় আসক্তদের যৌন সম্পর্ক স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এই ইয়াবার কারণে অনেক স্ত্রী স্বামীর ঘর করতে পারছে না। তিনি বলেন, অনেকে ইয়াবা গ্রহণ করে যৌন উদ্দীপক হিসেবে। প্রথম দিকে সেটা কাজ করে যেহেতু এটা খেলে শারীরিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তার যৌন ক্ষমতা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়। শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যায়। মেয়েদের মাসিকেও সমস্যা হয়। এম এন হুদা বলেন, মরণনেশা ইয়াবার হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, যত ধরনের মাদক আছে তার সবগুলোর সংমিশ্রণ হলো ইয়াবা। এটা একটা পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে ইয়াবা জনপ্রিয় হতে শুরু করে ২০০০ সালের পর থেকে যখন। টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মিয়ানমার থেকে এই ট্যাবলেট আসতে শুরু করে। তারপর এটি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, যেখানে যাকে যেভাবে মোটিভেশন করা দরকার তার কাছে সেভাবেই ইয়াবা তুলে দেওয়া হচ্ছে। যেমন শিক্ষার্থীদেরকে বলছে যে, এটা খেলে তুমি রাত জেগে পড়তে পারবে। কেউ মোটা হলে তাকে বলা হচ্ছে শরীর শুকিয়ে যাবে। গানের শিল্পীকে বলছে, ইয়াবা খেলে গলার কাজ ভালো হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইয়াবার কোন উপকারই নেই। ইয়াবা আসক্ত একজন সচিবের মেয়ে সম্প্রতি সুস্থ হওয়ার পথে। রাজধানীর একটি মাদকাসক্ত নিয়ময় কেন্দ্রে নিয়মিত চিকিত্সা নিচ্ছেন তিনি। আসক্ত সচিব কন্যা জানান, আমার স্বামীর মাধ্যমে ইয়াবার সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। সে আমাকে অনেক ভালোবাসতো। একদিন সে অনেকগুলো ইয়াবা নিয়ে আসে। সে বলে, এটা খুব ভালো জিনিস। এখন এটা সবাই খায়, মেয়েরাও খায়। আর তুমি তো আমার স্ত্রী। সুতরাং তুমিও আমার সাথে খাবে ও মেলামেশা করবে। আমি মনে করলাম, যদি তার সাথে বসে না খাই তাহলে হয়তো সে বাইরের মেয়েদের সাথে গিয়ে খাবে। কয়েক মাস ধরে খেলাম। তিন মাস পর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। এতো শুকিয়ে যাই আমাকে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মহিলার মতো দেখাতো। শরীর পুরোটা কালো হয়ে গিয়েছিল। আমার শরীরে অর্ধেক কাপড় থাকতো, অর্ধেক থাকতো না। আমি সারাক্ষণ মাথা আঁচড়াতাম। মনে হতো মাথায় শুধু উকুন। যে-ই দেখবে সে-ই আমাকে পাগল মনে করতো। আমার দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। হয়েছে বিচ্ছেদ।
ইয়াবায় আসক্ত পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পুত্র সম্প্রতি রাজধানীর এক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিত্সা নিয়ে অনেকটা সুস্থ হওয়ার পথে। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমি এতোই আসক্ত হয়ে গিয়ে গিয়েছিলাম যে, মা যখন আসতো তখন আমি তার সাথে খুব খারাপ আচরণ করতাম। আমি চোখে অনেক কিছু দেখতে থাকি। মুরগির মাংস দেখলে মনে হতো তার ভেতরে অনেক কেঁচো। মাথার চামড়াকে মনে হতো লাল রক্ত। খেতে পারতাম না। আমার মা একদিন ভাত মেখে খাওয়াতে যাবে তখন আমার মনে হলো আমাকে তিনি কেঁচো খাওয়াচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আমি বমি করতে শুরু করি। তখন তারা আমাকে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসে। সেখানে আমাকে চিকিত্সা দেওয়া হয়। এখন আমি অনেকটা সুস্থ হয়। এখন অনেক লজ্জা লাগে। কারণ মায়ের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছি। চিকিৎসকরা বলছেন, ইয়াবার কারণে পুরোপুরি বদলে যায় মানুষের জীবন ধারা। এই পরিবর্তনটা হয় খুব দ্রুত গতিতে। দিনে সে ঘুমাচ্ছে, রাতে জেগে থাকছে। পরপর কয়েকদিন সে ঘুমাচ্ছে না, কিন্তু আবার একটানা ঘুমাচ্ছে। ফলে মেজাজ অত্যন্ত চরমে উঠে যায়। কয়েকদিন পর দেখা যায় পরিবারের সবার সাথে তার ঝগড়াবিবাদ গণ্ডগোল লেগে যায়। তার মনে হয় সবাই খারাপ। তিনি একাই শুধু ভালো। কিছুদিন পর দেখা যায় যে প্যারানয়েড হয়ে গেছে। সে ভাবতে থাকে যে সবাই তার শত্রু বা সবাই তার পেছনে লেগেছে। সে সন্দেহ করতে শুরু করে যে তাকে কেউ মেরে ফেলবে, বিষ খাওয়াবে। তারপর ধীরে ধীরে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা আরো বলেন, ইয়াবা খেলে শরীরে একটা তাপ তৈরি হয়- যা কিডনিরও ক্ষতি করতে পারে। যেহেতু এটিকে ধোঁয়া হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তাই ফুসফুসে পানিও জমে যেতে পারে।