নিউজ ডেস্ক::
প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক সংকট রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। শিক্ষকশূন্যতা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, অবকাঠামো সমস্যাসহ নানা কারণে এখনও অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। এসব সমস্যার কারণে অবৈতনিক শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই শতভাগ ছেলেমেয়েকে স্কুলমুখী ও ঝরেপড়া রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বৌলতলী সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক একে একে অবসরে গেলেও নতুন করে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১২৬ জন শিক্ষার্থীর ভরসা একজন শিক্ষক। প্রতিদিন সব শ্রেণির ক্লাস নেয়া তো দূরের কথা, তিনি কোমলমতি শিশুদের সামাল দিতেই হিমসিম খাচ্ছেন।
স্কুলের শিক্ষক কাজী হারুনুর রশিদ বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমার স্কুলে পদ শূন্য। শিক্ষা অফিসারকে অনেকবার অনুরোধ করা হলেও কোনো শিক্ষক দেননি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬টি করে মোট ১৮টি সাধারণ বিষয় আছে। এছাড়া শারীরিক শিক্ষা, সঙ্গীতসহ সবমিলিয়ে প্রাথমিক স্তরে ৩২টি বিষয় পড়াতে হয়। একজন শিক্ষকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। স্কুলের তিনতলা ভবন। শিশুরা কেউ ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়, কেউ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে চায়। তাদের সামাল দেবেন না ক্লাস নেবেন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
একই উপজেলার গোলবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (২), ফুলবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম চাকামইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধানখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ২০টি স্কুল একজন থেকে দুজন শিক্ষক দিয়ে চলছে। অথচ চার থেকে ছয়জন শিক্ষকের পদ রয়েছে এসব স্কুলে। শিক্ষক সংকট শুধু কলাপাড়াতেই নয়, সারাদেশেই একই চিত্র।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) সূত্র জানায়, সারাদেশে পুরনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিন হাজার ৮০০, জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৫ হাজার ৮৫১টি এবং বিদ্যালয়বিহীন ১৫০০ গ্রামে স্কুল নির্মাণ প্রকল্পের ১২০০ স্কুল চালু করা হয়েছে। এসব স্কুলে প্রধান শিক্ষকের ৬০ হাজার ৪৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১৭ হাজার ৫০০টি পদ শূন্য।
অন্যদিকে সহকারী শিক্ষকের দুই লাখ ২৭ হাজার ২৯৬টি পদের মধ্যে ২৫ হাজার ২৯৫টি পদ শূন্য।বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে স্কুল চালু হলে একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়নি। অন্য স্কুলের ধার করা শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেয়া হচ্ছে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি সকালে এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ডে শিফটে সারাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এক বা দুজন শিক্ষক থাকায় তাদের পক্ষে একসঙ্গে তিনটি ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। শিক্ষকদের ক্লাস ছাড়াও শিশু জরিপ, উপবৃত্তি তথ্য সংগ্রহসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের নানা তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে হয়। এছাড়া তাদের দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়। তখন পাঠদান বিঘ্নিত হয়। ক্লাস ঠিকমতো না হওয়ায় অনেকে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিচ্ছে বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
কলাপাড়ার পশ্চিম চাকামইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শাহ আলম বলেন, চারজন শিক্ষকের মধ্যে তিনজন অবসরে যাওয়ার পরে একাই স্কুল সামাল দিচ্ছি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অনেক অনুরোধ করার পর গত জুলাইয়ে অন্য স্কুলের একজন শিক্ষককে আমার স্কুলে ক্লাস নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও দুজন শিক্ষকের পক্ষে একসঙ্গে তিনটি শ্রেণির ক্লাস নেয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, ক্লাসের বাইরেও সরকারি অনেক কাজ করতে হয়। স্কুলের কাজের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। তখন স্কুলের সাবেক ছাত্রদের ডেকে তাদের দিয়ে ক্লাস করানো হয়। একই অভিযোগ করেন বরগুনার আমতলী উপজেলার উত্তর-পূর্ব গুলিশাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোসাম্মৎ আকলিমা বেগম।
কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আরিফুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ায় পদগুলো শূন্য হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে মামলার কারণে সরকার শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যেসব স্কুলে এক বা দুজন শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে অন্য স্কুলের শিক্ষকদের অলিখিতভাবে ক্লাস নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। জাতীয়করণকৃত স্কুলে শিক্ষক সংকট বেশি বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, একজন শিক্ষকের দায়ের করা মামলাকে কেন্দ্র করে ২০০৯ সাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির নন-গেজেটেড পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। এরপর নানা জটিলতায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে এ পদে আর নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি পিএসসি ৩৪তম বিসিএস থেকে ৮৯৮ জনকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এসব পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ৪০ হাজার প্যানেল শিক্ষকের মধ্যে ৩৪ হাজার সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পুলের ২০ হাজারের মধ্যে চার হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকিদের নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে ডিপিই সূত্র জানিয়েছে।
ডিপিই মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, একাধিক মামলা থাকায় সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় প্যানেল শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। এখন পুল শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এসব নিয়োগ শেষ হলেই শূন্য ও সৃষ্ট পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করবো। তখন শিক্ষক সংকট থাকবে না বলেও তিনি দাবি করেন। জাগো নিউজ