২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের প্রায় তিন বছর হতে চলল; এ সময়ে ‘অপারেশন ১০২৭’ হতে চলেছে মিয়ানমার বিপ্লবের গতিপথ নির্ধারণকারী এক মুহূর্ত। ২৭ অক্টোবর শুরু এ অভিযান নিছক সামরিক আক্রমণ নয়। এটি মিয়ানমারের জনগণ, তাদের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের বিকাশমান জোটের অদম্য চেতনা এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্য তুলে ধরে। এ সংগ্রামের পেছনে যে অপ্রতিরোধ্য জনসমর্থন আছে, এ অভিযান তাও প্রমাণ করে।
শক্তির স্থিতিস্থাপকতা ও জনসমর্থন
বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সকে (বা উত্তরাঞ্চলীয় জোট) এর কৃতিত্ব দিচ্ছেন, যার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ)। তবে ভুলে যাওয়া উচিত নয়, জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) অধীনে মান্দালয় পিডিএফের মতো নতুন কয়েকটি গোষ্ঠী এবং বার্মা পিপলস লিবারেশন আর্মি (বিপিএলএ) উত্তর শান রাজ্যে আক্রমণে অংশ নিয়েছে। একটি বার্মিজ প্রবাদ ধার করে জোটের সম্পৃক্ততাকে বলা যায়, ‘মহিষ যখন সাঁতার কাটে, জল তখন প্রবাহিত হয়।’
এখানে মহিষ হলো বিপ্লব, যা এমন এক পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে, যেখানে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জড়িত হওয়া এবং লড়াই করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই দলগুলো উদীয়মান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে, অথচ তারা প্রথমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রন্ট খুলতে নারাজ ছিল।
অভ্যুত্থানের পরপরই কিছু রাজনীতিবিদ এবং বিশ্লেষক মিয়ানমারের সংকটকে নিছক ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমর্থকদের মধ্যকার একটি সংঘাত হিসেবে চিত্রিত করেছেন। একই বিশ্লেষকরা এখন অপারেশন ১০২৭-এর সাফল্যের জন্য বাহ্যিক কারণকে ক্রেডিট দিচ্ছেন। কিন্তু এই চীনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মিয়ানমারের জনগণের ক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতিকে হেয় করে। এ দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারে পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করা উচিত। কারণ এটি বস্তুগত পরিস্থিতি, যা বিপ্লবকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তাকেও অস্বীকার করে।
পরিবর্তনশীল ক্যালকুলাস
অভ্যুত্থানের পর থেকে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) এবং কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) মতো জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিপ্লবকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছে। তারা যেমন তরুণ বিক্ষোভকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি সংসদের বাস্তুচ্যুত সদস্যদের আশ্রয় দিচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন পরামর্শমূলক পরিষদেও যুক্ত থাকছে। তবে শুরুতে কেএনইউ এবং অন্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এমন কিছু দল ছিল, যারা বিপ্লবে আস্থা পায়নি; সামরিক শাসকের সঙ্গে তারা চুক্তিও করেছিল। কিন্তু জান্তার ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক অবস্থান এবং বিপ্লবের জন্য জোরালো জনসমর্থন এই গোষ্ঠীগুলোকে ওই অবস্থান ছাড়তে বাধ্য করে।
ভাঙা ছুরি বা কোঁকড়ানো বর্শা
বিদ্রোহীদের গত মাসের সাফল্যও সামরিক শাসনের বৈধতার ক্ষয় তুলে ধরে। একটি সুপরিচিত বার্মিজ প্রবাদ হলো, জনসমর্থনহীন একজন শাসক বল প্রয়োগ করতে গেলে শুধু ছুরিটি ভাঙবে বা বর্শাটা কোঁকড়াবে। সামরিক জান্তার কর্তৃত্ব প্রায় ঐক্যবদ্ধ জনসাধারণের বিরোধিতার ভারে ভেঙে পড়ছে; অপারেশন ১০২৭-এর সময় তার সৈন্যদের দলত্যাগ এবং আত্মসমর্পণের মধ্যে যা প্রমাণিত। টিএনএলএ এবং এমএনডিএএর মতো গোষ্ঠীগুলোর জন্য, যারা শান রাজ্যের জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে– বিপ্লব একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এনে দিয়েছে। বিশেষত এমএনডিএএ অতীতে সামরিক অভিযানের সামনে তার অঞ্চলগুলো হারিয়েছিল। এখন বিপ্লব একটি ক্রমবর্ধমান জোয়ারের মতো গতি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের মধ্যে তাদের স্থান নিশ্চিত করার একটি সুযোগ খুঁজে পায়।
বর্তমান বহুমুখী সমন্বিত আক্রমণ কতদূর যাবে, তা নির্ভর করে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর। উদাহরণস্বরূপ, আরাকান আর্মিকে রাখাইন রাজ্যে একটি ফ্রন্ট খোলার সময় মনে রাখতে হবে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইন জনগণকে বারবার সশস্ত্র এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত সহ্য করতে হয়েছে। তবে জনসাধারণের সংকল্পে এখনও ক্ষয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই আমরা আরও কৌশলগত আক্রমণ প্রত্যাশা করতে পারি।
অন্যদিকে, ক্ষয়িষ্ণু মনোবল এবং দলত্যাগের সমস্যায় জর্জরিত সামরিক বাহিনী বিপ্লবের ক্রমবর্ধমান জোয়ার মোকাবিলা করতে অক্ষম বলে মনে হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক ফ্রন্টে সমন্বিত আক্রমণ চলছে। বেসামরিক নাগরিকদের সম্পৃক্ততা এবং শক্তিশালী জনসমর্থন উন্নততর অস্ত্রধারী শত্রুর বিরুদ্ধে এই অসম আক্রমণগুলোতে একটি বিশাল পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, আহতদের সেবা দিয়ে, তহবিল সংগ্রহ করে এবং পিডিএফ গ্রুপগুলোকে মিয়ানমারের প্রবাসীদের সঙ্গে সংযুক্ত করে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ নামক সংগঠনের চিকিৎসা পেশাজীবীরা বিপ্লবের অকথিত নায়ক হয়ে উঠেছেন। এর আগে শুধু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যখন লড়ছিল তখন কিন্তু এমনটা দেখা যায়নি।
শুরুর শেষ
সামনের দিনে আমরা আরও সমন্বিত আক্রমণ এবং জোট গঠনের প্রত্যাশা করছি। যদিও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বেশি করে বিমান শক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে, কার্যকরভাবে স্থল অভিযান পরিচালনা করার অক্ষমতা কিন্তু সামরিক বিজয়কে অসম্ভব করে তোলে। সাধারণ সেনাদের মধ্যে মনোবল ক্ষয় হচ্ছে, যার আলামত সমগ্র সামরিক ইউনিটের অভূতপূর্ব আত্মসমর্পণে ফুটে উঠেছে। এটা সংঘাতের গতিপথে সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
যদিও এখনই এমনটা বলা যায় না, একটি নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ আসন্ন, তবে সিরিয়া বা লিবিয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আশঙ্কা নেই। বিপ্লবটি বহুমুখী, রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক ফ্রন্টকে অন্তর্ভুক্ত করে তা ঘটছে। বিশ্লেষকরা বাহ্যিক হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে চীন থেকে আক্রমণের মাধ্যমে এর দ্রুত সমাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। তবে তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এবং জাতীয় অনুভূতির অবস্থার গভীরতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। চীনের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ অবশ্যই, তবে মিয়ানমারের জনগণের সামাজিক-রাজনৈতিক ইচ্ছাকে ছাপিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই, যা শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের গতিপথকে নির্দেশ করবে। অপারেশন ১০২৭-এর সাফল্য উল্লেখযোগ্যভাবে জনসাধারণের মনোবলকে শক্তিশালী করেছে, যা এনইউজির সাম্প্রতিক তহবিল সংগ্রহ প্রচেষ্টার মধ্যেও প্রতিফলিত।
যখন জনসাধারণ বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর সামরিক সাফল্য উদযাপন করে, তখন বেসামরিক জনগোষ্ঠীর অংশগুলোর প্রতি, বিশেষ করে সংখ্যালঘু এলাকায়, যারা সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; সহানুভূতিশীল হওয়াও অপরিহার্য। অতএব, জাতিগত সংহতি গড়ে তোলা একটি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ, যা শান্তি, স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি এবং একটি অংশীদারিত্বমূলক ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে। সামরিক জান্তা এক অভূতপূর্ব মাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, যা তাকে প্রায় অনিবার্য পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এটি ঘটে, তা একটি দীর্ঘ সংগ্রামের প্রাথমিক সমাপ্তির ইঙ্গিত দেবে, যার লক্ষ্য বর্তমানে মিয়ানমারের জাতি বলতে যা বোঝায়, তার আওতায় সব জনগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা।
টেট মিন লুইন: টরন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক; থিহা উইন্ট অঙ: টোকিও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজে কর্মরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী;
দি ডিপ্লোম্যাট থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন