প্রস্তাবিত শিশুবিয়ে আইনে বাস্তবসম্মত চিন্তা থেকেই বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘আইনটিতে আমরা ‘তবে’ ব্যবহার করলাম কেন, তা নিয়ে যারা বড় বড় কথা বলছেন, তারা গ্রামের বাস্তব অবস্থাটা জানেন না। কারণ তারা দু’টো এনজিও করে পয়সা কামান। কিন্তু দায়িত্বটা নেন না। তবে আমি যতদিন সরকারে আছি, মনে করি এটি আমার দায়িত্ব। তার জন্য এই বিশেষ বিধান করে দিয়েছি। একটি মেয়ে যদি যেকোনও কারণে ১২/১৩ বা ১৫/১৫ বছরের সময়ে গর্ভবতী হয়ে যায়, তাকে গর্ভপাত করানো গেল না। তাহলে যে শিশুটির জন্ম নেবে, তার অবস্থা কী হবে? তাকে কি বৈধ বলে কেউ মেনে নেবে? নেবে না। তাহলে এই বাচ্চাটির ভবিষ্যৎ কী হবে? এই ধরনের কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সেখানে যদি মা-বাবার মত নিয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে যদি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মেয়েটি বেঁচে গেল, তার বাচ্চাটিও বৈধতা পেল।”
আমরা আশা করেছিলাম মেয়ে শিশুদের বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন এবং প্রস্তাবিত শিশুবিয়ে আইনের এই বিশেষ বিধান রহিত করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এরকম বক্তব্য আসার পর স্বাভাবিকভাবেই আমি এবং আমরা আমাদের আশার কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঠোকার শব্দ পেলাম। হতাশা ছাড়া এর পর আর কিছু নেই আমাদের এবং আমাদের মেয়েদের সামনে। সত্যিই হয়তো বাংলাদেশের মতো মোল্লাতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মাতৃসুলভ দায়বোধ থেকেই শিশুর পিতৃপরিচয় নিশ্চিত করার জন্য এই বিশেষ বিধান রেখেছেন, যাতে মেয়েটি বেঁচে যায় এবং বাচ্চাটি বৈধতা পায়(?)।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মেয়েদের এইভাবে বাঁচানো যায় না শেষ পর্যন্ত। এই দেশে মেয়েদের বাঁচার পথ এতোটা শর্টকাট যে হয়নি তা আপনিও খুব ভালো করেই জানেন। একটি শিশুর গর্ভে জন্ম নেওয়া আর একটি শিশু পিতৃপরিচয় বা বৈধতা পেলেই এই দেশে একটি মেয়ে ফিরে পায় না তার সম্মান, সম্ভ্রম, স্বপ্ন আর জীবন। এই দেশে মেয়েদের সম্মান আর জীবন সবটুকুই শরীরে আর চরিত্রে থাকে। তাই বখাটেরা বাজে উক্তি করলে এখানে মেয়েদেরই সম্মান যায়, বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে পুরুষরা গায়ে হাত দিলে মেয়েদেরই চরিত্র নষ্ট হয়, গার্মেন্টস এ চাকরি করলেও মেয়েদের সম্মান যায়, রাত করে বাড়ি ফিরলে মেয়েদের চরিত্র নষ্ট হয়, মাথা উঁচু করলেও মেয়েদের সম্মান যায়, তালাক নিলে বা দিলেও মেয়েদের সম্মান যায়। এই দেশে মেয়েদের সম্মান আর জীবন বাঁচে শুধু একজন পুরুষের অধীনে থাকলে। এবং সে বাঁচা যে কেমন বাঁচা তা আপনার তো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
একজন বিকৃত পুরুষই কেবল একজন শিশুকে ফুসলিয়ে বা জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এখন সেই সম্পর্কের ফলে একটি অনাকঙ্খিত গর্ভধারণকে বৈধতা দেয়ার জন্য আমাদের শিশুকন্যাদেরকে সেই ধর্ষকামী পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে সারাজীবন একটা অসম-বিকৃত যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা অথবা ধর্ষকের কাছে বলিদানই কি তবে আমাদের মেয়েদের বাঁচার একমাত্র পথ? আপনি বলেছেন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করা মেয়েদের বিরুদ্ধে সমাজের নিপীড়নের ভয়ের কথা। নারীর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ কাঠমোল্লা আর পুরুষশাসিত সমাজপতিদের এই নিপীড়ন আর রক্তচক্ষু তো নতুন কিছু নয়। ধর্মের নামে নারীকে অবরুদ্ধ করার এই পুরুষতান্ত্রিক চক্রান্ত বোঝার পরও যদি মেয়েদের বাঁচার জন্য ধর্ষকামী, বিকৃত পুরুষের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে যাক, মরেই যাক এদেশের সব মেয়ে। মরেই বেঁচে যাক। আমরাই শুধু বেঁচে থেকে দেখতে থাকি ধর্মান্ধ মৌলবাদের আস্ফালন আর তের দফার জয়োল্লাস।
যদি ধরেও নিই যে, একজন মেয়েশিশু যে কোন কারণে গর্ভধারণ করে ফেললে তাকে বিয়ে দিয়ে সম্মান বাঁচানোই একমাত্র পথ, তাহলেও তো এই প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এই “কোন কারণে” একজন শিশুকে গর্ভধারণ করানোটা কি তবে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিচ্ছে? একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে কোনো শিশুর কী আদৌ বৈবাহিক বা অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, বা রাষ্ট্রের সেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত? এই অসম বিয়ের ফলে অপরিপক্ক প্রজনন প্রক্রিয়া, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ এবং প্রসবের দিকে ঠেলে দিয়ে মেয়েদের বাঁচাবো আমরা? শুধু গ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে বলেই শিশুটিকে আমরা এক ভয়ঙ্কর বৈবাহিক জীবনের দিকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ রাখবো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এই সুযোগে এই দেশে বাচ্চা মেয়েগুলোকে ফুসলিয়ে বা ধর্ষণের মাধ্যমে গর্ভধারণের মহামারী লেগে যাবে না তো? আর এক বার ভেবে দেখবেন দয়া করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের ফলে জন্ম নেয়া এই বিশেষ শিশুদের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। আমরাও তাই চাই, প্রিয় নেতা। এদেশের সকল পিতৃপরিচয়হীন শিশুর দায়িত্ব নিতে আপনার কলমই যথেষ্ট। আপনি একটি আদেশ জারি করলেই কাল থেকে কোন শিশু পিতৃ পরিচয়ের সংকটে পড়বে না, শুধু মায়ের নাম ব্যবহার করেই শিশুর জন্মনিবন্ধন হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে, চাকরির সুযোগ পাবে। আপনি চাইলেই এই দেশে “কোন কারণে” মেয়েশিশু গর্ভবতী হয়ে গেলে ও সেই শিশু-মা কে পতিতালয়ে যেতে হবে না, বা একটা ঝুঁকিপুর্ণ বিয়ের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হবে না। রাষ্ট্রই এধরনের শিশু এবং তার মা (যে নিজে ও শিশু) উভয়ের দায়িত্ব নিবে। আপনিই বলেছেন উন্নত দেশে এমনটাই ঘটে। তাহলে আজকের এই উদার বাংলাদেশে কেন একজন শিশুকে বয়স্ক পুরুষের সাথে অসম যৌন সম্পর্কের বাধ্যবাধকতায় ঠেলে দেয়ার শর্টকাট রাস্তায় হাঁটা হচ্ছে?
বিনয়ের সাথে বলছি প্রিয় নেতা, এই দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই এনজিওরা গত চল্লিশ বছর ধরে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে সরকারের সহযোগী হয়ে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের সাথে এনজিওরা সমানভাবে কাজ না করলে, চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যুহার কমানো, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এইচআইভিএইডস, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এর মতো চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতোনা। শিশু বিয়ে কমিয়ে আনার জন্য এই যে লড়াই, সামাজিক সচেতনতা, কিশোরীদের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি, আয়মূলক প্রশিক্ষণ, স্কুল ক্যাম্পেইন,স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো কার্যক্রমও এনজিওর দায়িত্ববোধেরই প্রমাণ।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আজ বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে এসেছে আপনার হাত ধরেই। কিন্তু ঠিক এমন একটি সময়ে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি ও মৌলবাদী চক্রান্তের কাছে নতজানু হয়ে শিশুবিয়ের মতো একটি অন্ধকারকে স্বাগত জানালে যে মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ছয়টি অর্জনকেই ব্যর্থ করে দিবে, এই দিকটা আপনি নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন। মেয়ে শিশুর স্থায়ী নিরক্ষরতার হার বেড়ে যাবে, দেশে শিশু বিয়ের হার বেড়ে যাবে, মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে, শিশুমৃত্যু বাড়বে, অপরিণত শিশু জন্ম নিবে, এবং শিশু বয়সেই তালাকপ্রাপ্ত হয়ে সন্তানসহ বাবা-মার ঘরে বোঝা হয়ে ফেরত আসবে, দারিদ্র্য-চক্র শক্তিশালী হবে, বহু বিবাহ বাড়বে, শিশু ও নারী নির্যাতন বাড়বে। সরকার কিভাবে এটা মোকাবেলা করবে?
শিশু বিয়ের এই সুযোগ সৃষ্টি হলে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্ধকার নিমজ্জিত অনেক দেশের মতোই নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা জগদ্দল পাথরের মত সমাজে জেঁকে বসবে। ধর্মান্ধ মৌলবাদ প্রশ্রয় পাবে এবং আরো পশ্চাদপদ দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হবে। যেমন হেফাজত ইতিমধ্যেই তের দফা পেশ করেছে। আপনার হাত ধরেই কি তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে হেফাজতের তের দফা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে? আল্লামা শফিরা “নিরাপত্তা” আর “বৈধতা”র “তেঁতুল তত্ত্ব” দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে ঘরের বাইরে আসা মেয়েদের? নারীর ক্ষমতায়নের আলো জ্বলতে শুরু করা এই দেশে মেয়েরা আবার ফিরে যাবে অন্ধকার গৃহকোণে? হাতে করে গলাটিপে হত্যা করা হবে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ নামের শিশুটিকে, যে শিশুটি আপনার যত্নেই বেড়ে উঠতে পারতো ?
এই দেশে আপনার ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। তাই শিশু বিবাহের আইন শিথিল না করে বরং গ্রাম্য কাঠ মোল্লাদের ও নির্যাতনকারী পুরুষদের কঠোর হাতে দমন করুন। যে ফাঁক দিয়ে শিশু মেয়েরা গর্ভধারণের ঝুঁকিতে পড়ে সেই ফাঁকগুলো চিহ্নিত করে ঠিক সেখানে কাজ করুন, স্কুলে জেন্ডার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করুন, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনকে কঠোর নজরদারিতে আনুন। আপনি চাইলেই এই দেশে প্রতিটি মেয়ের চলার রাস্তা নিরাপদ হবে, বিচারহীনতার সুযোগে কোন ধর্ষক আর একটি মেয়েকে ও আতঙ্কিত করতে পারবে না। আপনি চাইলে এদেশের প্রতিটি মেয়ে বেণি দুলিয়ে হলুদ শর্ষে ফুলের সাথে দোল খেতে খেতে বই কোলে নির্ভয়ে স্কুলে যাবে। পুরুষতান্ত্রিক একটি দেশের সরকারপ্রধান হয়ে যদি নাও পারেন, একজন মা হয়েই না হয় আমাদের মেয়েদের শৈশবটুকু আপনি বাঁচিয়ে রাখুন! সেটিই হবে মেয়েদের সত্যিকারের বাঁচার পথ।
লেখক : কলামিস্ট।