দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্বাগতিকদের প্রথমবার হারাল বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জয় ৩৮ রানে।
এই মুহূর্তটা দেখার জন্য কত সময় অপেক্ষা বাংলাদেশের। কত বিনিদ্র রাত কাটানো, কত ভুল শুধরে নতুন করে লড়াই…কিন্তু পরম আরাধ্য জয়টা হাতের মুঠোয় আসে না। দেশে সিরিজ জয় ও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ও বিশ্বকাপ মঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর স্বাদ পাওয়া গেছে আগেই। কিন্তু প্রতিপক্ষের মাঠে তাদের হারানোর যে মধুর স্বাদ তা পাওয়া যায় অন্য কোথায়?
সেই দিনটি সেঞ্চুরিয়নে আজ দেখেই ফেলল বাংলাদেশ। তাইতো রাতের অন্ধকার ভেদ করে গর্জে ওঠে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে মানচিত্রের প্রতি বর্গইঞ্চিতে। প্রথমবার প্রোটিয়া দুর্গ ভাঙার আনন্দ একটু বেশি তো হবেই।
কথা রাখলেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। কথা রাখলেন কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও। দুজনই বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন কিছু করতে চাই যা বাংলাদেশের অন্য কোনো দল আগে করেনি।’ দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ প্রথম সফর করেছিল ২০০২ সালে, সবশেষ ২০১৭ সালে। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৯ ম্যাচ ছিল না কোনো জয়।
পরাজয়ের স্তুপ সরিয়ে তামিম, সাকিব, মুশফিকরা পরলেন বিজয়ের মালা। আফিফ, মিরাজ, ইয়াসির, শরিফুলরা দেশকে ভাসালেন অনাবিল আনন্দে।
সেঞ্চুরিয়নে টস বরাবরই ভাইটাল। তেম্বা বাভুমা টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে ম্যাচের অর্ধেকেই যেন এগিয় গিয়েছিলেন। কিন্তু নাহ…২২ গজের খেলায় তেমন কিছু হলো না। ৭ উইকেটে ৩১৪ রানের পুঁজি পেয়ে স্বাগতিকদের কঠিন চ্যালেঞ্জ দেয় বাংলাদেশ। শরিফুল, তাসকিন, মিরাজদের কাটা বিছানো পথ পাড়ি দিতে পারেননি ডুসেন, মিলররা। তাদেরকে ২৭৬ রানে থামিয়ে বোলাররা জয়কে করেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত।
বড় পুঁজি পেতে অতিথিদের জন্য লম্বা পথ পারি দিয়েছেন বড় তারকা সাকিব আল হাসান। মানসিক ও শারীরিকভাবে খেলার মতো অবস্থায় নেই বলে এই সফরে বিশ্রাম চেয়েছিলেন তিনি। নানা নাটক শেষে তিনি উঠে যান দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে। আজ শুক্রবার (১৮ মার্চ) নেমে পড়েন ২২ গজের লড়েইয়ে। ৭৭ রানের নজরকাড়া ইনিংস খেলে ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক তিনি।
টস হেরে ব্যাটিং করতে নেমে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের চিত্র ছিল দুই রকম। শুরুটা একদম পাওয়ারহীন। মাঝে ও শেষটায় বাজিমাত। আগের দিন তামিম জানিয়েছিলেন, নতুন বলে ১৫ ওভার উইকেট যতটা আগলে রাখতে পারবেন শেষদিকে ততটা সুবিধা পাবেন। সেই পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশ এগিয়েছে। উইকেট না হারিয়ে ২০ ওভারে দলীয় রান ৯০। প্রথম ১০ ওভারে ছিল ৩৩। ৯৫ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙে তামিমের আউটে (৪১) । লিটন কিছুক্ষণ পরই ফেরেন ৫০ রানে। মুশফিক দ্রুত রান তুলতে গিয়ে আউট হন ৯ রানে। এরপরই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের চিত্র পাল্টে যায়। বলের ঔজ্জ্বল্য কমায় ব্যাটিং তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। আগ্রাসন দেখিয়ে ৮.৫১ রান রেটে সাকিব ও ইয়াসির চতুর্থ উইকেটে যোগ করেন ১১৫ রান। যা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের রেকর্ড।
তাদের ব্যাটে শেষ ৩০ ওভারে ২২৪ রান পায় অতিথিরা। যার নেতৃত্বে ছিলেন অনবদ্য সাকিব। শুরুটা ধীরস্থির হলেও থিতু হওয়ার পর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬৪ বলে ৭ চার ও ৩ ছক্কায় ৭৭ রানের ইনিংসটি ছিল মনমুগ্ধকর।
এনগিডি, রাবাদাকে মাথার ওপর দিয়ে যেভাবে ছক্কা মেরেছেন তাতে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি কোনো জড়তা আছে তার ভেতরে। এ ইনিংস খেলে তামিমের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ফিফটির ফিফটি কীর্তি গড়েছেন সাকিব। সঙ্গে ইয়াসিরের যোগ্য সঙ্গ আত্মবিশ্বাসী করে তোলে পুরো দলকে।
আফগানিস্তান সিরিজে অভিষেকের পর নিজেকে তেমন মেলে ধরতে পারেননি ইয়াসিন। তবে বিরুদ্ধ কন্ডিশনে নিজের সামর্থ্য দেখিয়েছেন দারুণভাবে। ৪৪ বলে ৪ চার ও ২ ছক্কায় পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম পঞ্চাশ রাবাদাকে ফ্লিক করে মিড উইকেট দিয়ে হাঁকানো ছক্কা নিশ্চিতভাবে ক্রিকেটপ্রেমিদের চোখে আটকে থাকবে দীর্ঘদিন। তবে তার পছন্দের শট ছিল এনগিডিকে মারা স্ট্রেইট ড্রাইভ। শেষ দিকে মাহমুদউল্লাহর ২৫, আফিফের ১৭ ও মিরাজের অপরাজিত ১৯ রানে বাংলাদেশের রান চলে যায় চূড়ায়।
বোলিংয়ে শুরুতেই শরিফুলের আঘাত। উইকেটে পেছনে ক্যাচ দেন মালান। এরপর তাসকিনের এক ওভারে সাজঘরে ভেরাইন ও মার্করাম। ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে প্রবল চাপে পড়া স্বাগতিকের টেনে তোলেন ডুসেন ও বাভুমা। দুজনের ৮৫ রানের জুটিতে ভয় জাগিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে শরিফুলের ভয়ংকর এক বাউন্সারে বাভুমাকে ফেরান ৩১ রানে।
এরপর মিলার এসে প্রতি আক্রমণে রান তোলেন। ডুসেন ফিফটির পর ইনিংস লম্বা করতে থাকেন। ৬৪ বলে ৭০ রানের জুটিতে আবার ম্যাচে ফেরে প্রোটিয়ারা। কিন্তু সীমানায় ইয়াসিরের অসাধারণ এক ক্যাচে ডুসেন আউট হলে বাংলাদেশকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডুসেন ৮৬ রানে আউট হন। গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো মিলার একপ্রান্তে চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে রানের চাকা সচল রাখেন। কিন্তু লেজের ব্যাটসম্যানদের ফেরানো মিরাজ তাকে ঘূর্ণিতে পরাস্ত করে স্টাম্পড করেন ৭৯ রানে। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যায় সেখানেই। পরের ব্যাটসম্যানরা পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনেন শুধু।
শুরুর ৪ ওভারে ৩৮ রান দেওয়া মিরাজ পরের ৫ ওভারে ২৩ রানে নেন ৪ উইকেট। এছাড়া তাসকিনের ৩ ও শরিফুল ২ উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের জন্য কাজটা কঠিন করে তোলেন। সাকিব উইকেট না পেলেও নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে আটকে রেখেছিলেন প্রোটিয়াদের।
আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে ১০০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের ঝুলিতে যোগ হলো আরো ১০ পয়েন্ট। সামনের পথ চলায় এই পয়েন্ট বড় ভূমিকা রাখবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাঠকের মতামত