এম.এ আজিজ রাসেল::
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী—গদ্যময়, পূর্ণিমা—চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। মারুফাকে সেদিন বাবা বলেই দিলো, ‘আমি টাকা দিতে পারব না। তুই একা কী করবি, কর! যে বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে বাড়িতে শখ করা অপরাধ হতে পারে, স্বপ্ন দেখা তো আর অপরাধ না! মারুফা স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন গায়ে মেখেছেন। না বলা গল্প অহেতুক ভিড় জমানোর আগে সেই স্বপ্নের বাগিচায় মারুফা পৌঁছে গিয়েছেন। ধূসর একটা উপক্রমণিকা থেকে রঙিন একটা পথচলা যেমন হয়!
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ঢেলাপীর এলাকার কৃষক পরিবারের মেয়ে মারুফার। মা—বাবা, চার ভাই—বোনসহ ছয়জনের বড় পরিবার। ছয়টি মুখের আহার জোগাড় করতেই বর্গাচাষি বাবা আইমুল্লাগহ’র ঘাম ছুটে যায়। সেই পরিবারে মেয়ে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করবে, গরু দেখাশোনা করবে, গরুর খাবার জোগান দিতে বাড়ির পাশের জমিতে ঘাস চাষ করবে এটাই তো বাবার চাওয়া। স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলার পাশাপাশি সে কাজগুলো ছোটবেলা থেকে করেই এসেছেন মারুফা। এলাকায় আপন বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছেন ক্রিকেটও।
ক্লাস সিক্সে মারুফার বায়না কোচের কাছে গিয়ে ক্রিকেট শেখা। মারুফার ঘরে বায়না কি আর মানা যায়! তাই বাবা—মার কড়া জবাবে ছিলো কেবল না আর না। সে না এর ভয় কে জয় করে ২০১৮ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পে যান। বিকেএসপির নজরে আসা তখনই। তবে, আবার চিরচেনা অভাবের অন্ধকার। আর্থিক কারণে ভর্তি হতে পারেনা মারুফা। পরে সুযোগ হয় খুলনা বিভাগীয় দলে। ২০১৯ সালে জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব—১৯ জাতীয় দলের ক্যাম্পে। করোনার কারণে বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্প স্থগিত হয়ে গেলে আবার বাড়ি ফিরে যান। তারপর আবারো চিরচেনা গ্রাম, গ্রামের মাঠ আর লাঙল—জোয়াল। কৃষিকাজে লেগে যান বাবার সাথে।
ফসলের মাঠ থেকে ক্রিকেটে অদম্য মারুফা
সেই সব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসলে এগিয়ে আসে বিসিবি। মারুফা ঠিকানা বিকেএসপি। বছর না পেরোতেই ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক নৈপুণ্য দেখিয়ে ১৮ বছর বয়সেই ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে।তারপর নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের টি—টুয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে নিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার মারুফা।
গত রোববার ভারতকে ওয়ানডেতে প্রথমবার হারানোর কীর্তি গড়ে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে ভারতকে ১১৩ রানে থামিয়ে দেওয়ার পথে ২৯ রানে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নেন মারুফা। তারপর নারী ক্রিকেটারদের র্যাংকিংয়ের সাপ্তাহিক হালনাগাদ মঙ্গলবার প্রকাশ করলে সেরা ১০০ বোলারের মধ্যে জায়গা করে নেন মারুফা।
ছোট্ট একটা গ্রামে মাটির মেয়ে মারুফার আকাশছোঁয়া স্বপ্নে আজ মারুফার বাবারা কি গর্ববোধ করেন না? যে হাতে একসময় লাঙল—জোয়াল ছিল, সেই হাতে আজ বল নিয়ে দেশের জন্য স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন মারুফা। অবশ্য সেই লাঙল—জোয়াল থেকেই নাকি মারুফা শক্তিটা পেয়েছেন। পরিশ্রম করার শক্তি। মারুফা যে কেবল সামনেই এগোতে চাইবেন এখান থেকে, তা আর বলতে।