মাহবুবা সুলতানা শিউলি :
কেস স্টাডি ১ : হৃদম অসম্ভব মেধাবী ও ভালো একটা ছেলে। এক কথায় সোনার টুকরা ছেলে বলতে যা বুঝায় হৃদম সে রকম ছেলে। লেখাপড়ার বাইরে তার কোন জগতই নেই। প্রতি ক্লাসেই সে প্রথম স্থান দখল করে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাবা-মা তাকে কম্পিউটার কিনে দেন। কম্পিউটারে এমএসওয়ার্ড, এমএসএক্সেল সহ প্রয়োজনীয় আনুসঙ্গিক যা যা আছে সব কিছু শিখে নেয় সে। সব কিছুতে তার পারদর্শিতা দেখে তার বাবা-মা খুব গর্ববোধ করেন। তার আরো উন্নত পড়াশুনার জন্য বাবা-মা ইন্টারনেট সংযোগ এনে দেয় তার কম্পিউটারে। সে এখন কম্পিউটারে রীতিমত পড়াশোনা করছে। বাবা-মাও চেক করে দেখেন। সবকিছু দেখে বাবা-মা বেশ সন্তুষ্ট।
হৃদম বড় হচ্ছে। বন্ধুরা সবাই ইন্টারনেটে ফেসবুক, মেসেঞ্জারসহ অনেক কিছু ব্যবহার করছে। সে এতদিনে ফেসবুকে একাউন্ট না খোলায় হৃদমকে তার বন্ধুরা আনস্মার্ট বলে খেপায়। সামনে জেএসসি পরীক্ষা। এখন দিনরাত মন দিয়ে পড়তে হবে। বন্ধুদের বাজে কথা শুনার সময় নেই। যথারীতি সে সবার চেয়ে অনেক বেশি ভাল রেজাল্ট করলো। হাতে এখন কিছুটা সময় আছে। তাছাড়া এখনো সে রকম পড়ার চাপ সৃষ্টি হয়নি। তাই সে ভাবলো ফেসবুকে একটা একাউন্ট খোলেই ফেলি। বন্ধুরাও আর ঘরকুনো আনস্মার্ট ছেলে বলবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। ফেসবুকে বন্ধুদের বিভিন্ন পোস্ট, শেয়ার এগুলি ওর বেশ ভালই লাগে। এছাড়া অনেক অজানা বিষয়ও জানা হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বাবা-মা সবারই ফেসবুক একাউন্ট আছে, সুতরাং এটা নিয়ে এত অস্বস্তির কিছু নেই। ইদানীং ওর মধ্যে পরিবর্তনটা মা লক্ষ্য করেছেন। ওকে সাবধানও করেছেন। কিন্তু সে মাকে বুঝ দেয়, মা যেন তার উপর কন্ফিডেন্ট রাখেন। সময় গড়িয়ে যায়। হৃদম যেন কেমন হতে থাকে। স্মার্টফোনের জন্য বাবা-মাকে চাপ দেয়। বন্ধুদের সবার স্মার্টফোন আছে। কত প্রয়োজন স্মার্ট ফোনের। হোয়াটস্অ্যাপ-ভাইবারে টিচার-বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্য স্মার্টফোন লাগবে। শেষ-মেষ বাধ্য হয়ে তাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে হল। হৃদম এখন সেই আগের হৃদম নেই। স্মার্টফোনই যেন তার জগত। এখান থেকে সে কোন ভাবেই বের হয়ে আসতে পারে না। যেহেতু সে মেধাবী ছেলে পড়ালেখার চাপ তার কাছে খুব একটা কষ্টকর নয়। তাই রেজাল্ট ভালই করে যাচ্ছিল কিন্তু তার রুটিন এলোমেলো। সকালে উঠতে তার অনেক কষ্ট হয়। বিকালেই ঝিমুনি ভাব কিন্তু সারারাত জেগে জেগে ইন্টারনেটে বিচরণ করে সে। যা হবার তাই হলো। বাবা-মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এসএসসি তে সে মোটামুটি রেজাল্ট করলো। তার কিছু দিন পরেই ঘটলো সবচেয়ে বড় অঘটন, উগ্র দেখতে একটা মেয়েকে এনে বলে ও আমার বউ। ফেসবুকে পরিচয়, সারারাত জেগে মেসেঞ্জারে চ্যাট করত ওর চেয়েও বয়সে বেশ বড় বখে যাওয়া মেয়েটি। হৃদম নামের সোনার টুকরাটি পুরোপুরিই কয়লায় পরিণত হলো। তারপর ঐ পরিবারটির উপর কী কী অশান্তি নেমে আসতে পারে প্রিয় পাঠকগণ, আপনারাই মনে মনে যে যার মত কল্পনা করে নিতে পারবেন !!
কেস স্টাডি ২ : নীশিতা ও রবিন পরস্পরকে পচন্ডরকম ভালবাসে। দু’জনই স্মার্ট, বিচক্ষণ। রবিন পড়ালেখা শেষে ব্যবসা শুরু করে। নীশিতা সব সময় তাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। রবিন একটু একটু করে যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। এদিকে নীশিতাও পড়ালেখা শেষ করে ভাল একটা জব করছে। একটা সুন্দর দিনক্ষণ সময় দেখে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। একে অপরকে সম্পর্কের শুরু থেকেই তারা অন্ধের মত ভালবাসে। দিনগুলি তাদের চমৎকার কাটছিল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে আইডল জুটি তারা। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। ওদের ফুটফুটে সুন্দর দুইটি ছেলে মেয়েও আছে। সবকিছুই সুন্দরভাবে চলছে। এদিকে রবিন ব্যবসায়িক কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের লালন পালনের জন্য নীশিতাও জব ছেড়ে ঘরে সময় দিতে লাগলো। এদিকে বাচ্চারাও কিছুটা বড় হয়েছে। ওদের পিছনে এখন আগের মত সারাক্ষণ লেগে থাকতে হয় না। নীশিতা আবার কাজে যোগ দিতে চায়। কিন্তু রবিন বেঁকে বসে। বলে, প্রয়োজন নেই জবের তোমার। বাইরে আমি কাজ করছি, তুমি বাসাতেই সময় দাও। ঘর সংসার দেখো। এই, সেই। একথাগুলি বলার মধ্যে বুঝিয়ে বলা বা কোন অনুরোধ বা সৌন্দর্য ছিল না বরঞ্চ আদেশ বা খবরদারী ছিল। সংসারের সুখশান্তির জন্য নীশিতা চুপ করে থাকে। তবে ভিতরে ভিতরে রবিনের প্রতি মারাত্মক আক্রোশ জমে তবে তা প্রকাশ করে নি। রবিন যেন আর আগের রবিনটি নেই। সবকিছুতেই খবরদারী করতে পছন্দ করে। সবসময় যেন জ্ঞান দিতে চায়। ওদের মধ্যে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যেন আর নেই। সবকিছুতেই নীশিতার একঘেয়েমি লাগে। এভাবে একটু একটু করে সাময়িক দূরত্ব সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। নীশিতা কোন ভাবেই রবিনের সাথে আর স্বাভাবিক হতে পারে না। নীশিতা উপলব্ধি করে, কোন কিছু শেয়ার করার মত মন মানসিকতা রবিনের নেই। রবিন বুঝে শুধু তার ব্যবসা, তার নিজের কেরিয়ার। সংসারের পাশাপাশি নীশিতারও যে একটা চমৎকার কেরিয়ার হতে পারতো, শুধুমাত্র রবিনের কথামত সংসারের জন্য নীশিতার এ সেক্রিফাইসের কোন মূল্যই আর রবিনের কাছে নেই। রবিন সব ভুলে গেছে। রবিনের কাছে নীশিতা সংসারের জন্য শুধুই দায়ীত্ব পালন করার এক যন্ত্র। নীশিতা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। তারপরও নীশিতা সবসময় রবিনকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সংসারী করে তোলে রবিনকে তার কেরিয়ার গঠনে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিধিবাম! এত সেক্রিফাইসের পরও নীশিতা ইদানীং লক্ষ্য করছে রবিন যেন ফেসবুক মেসেঞ্জারে বেশ সময় দিচ্ছে। বাসায় এসে তার সাথে সুন্দর সময় কাটানোর বদলে স্মার্টফোনে ডুবে থাকে। দেখতে চাইলে বলে নীশিতা তোমার কাছ থেকে এই সব হীনমন্যতা আমি আশা করিনা। কিন্তু নীশিতার মনে সন্দেহ জাগে। সে না ঘুমিয়ে গভীর রাতে রবিনের মোবাইল চেক করে। যা বুঝার সে বুঝে গেছে। অফিসের পিএস মেয়েটার সাথে রবিন টাইমপাস করছে। আর এসব মেয়েগুলি কেরিয়ারের উচ্চ সিঁড়িতে ওঠার জন্য অনেক কিছুই করে। সব প্রমাণ যখন হাতে নাতে দেখালো তখন রবিন নীশিতার কাছে ক্ষমা চায়লো। নীশিতা হয়তো সাময়িকভাবে রবিনকে ক্ষমা করেছে, কিন্তু তার মনের ভিতর রবিনের প্রতি ঘৃণার যে পাহাড় জন্মেছে তা রবিন বুঝতে পারে নি। যাইহোক রবিন পুনরায় কাজে মন দেয়। কিন্তু নীশিতার ভিতর হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সে ক্ষত মুছতে এবং রবিনের ওপর প্রতিশোধ নিতে সে নিজেও জড়িয়ে যায় ফেসবুক আসক্তিতে। পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথেই চ্যাট হয়। পুরনো বন্ধু-কলিগরা নক করতে থাকে। নীশিতার মত সুন্দরি স্মার্ট মেয়ের সাথে সবাই বন্ধুত্ব করতে চায়। এভাবে অনেকের সাথে চ্যাট, ফান করতে করতে এক সময় তার পূর্ব পরিচিত বন্ধু রাকেশের সাথে নীশিতার গভীর বন্ধুত্ব হয়। নিজের একাকিত্ব, পরিবারের প্রতি তার সেক্রিফাইস সহ নিজের সব দুঃখ কষ্ট শেয়ার করে রাকেশের সাথে। বন্ধুত্ব থেকে গভীর বন্ধুত্ব, গভীর বন্ধুত্ব থেকে এক সময় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে নীশিতা। রবিনও তার কেরিয়ার, ব্যবসায়িক ব্যস্ততা সবকিছু মিলে বুঝে উঠতে পারেনি নীশিতা যে তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যখন জানতে পারে তখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে! নীশিতা ও রাকেশের পরকীয়া প্রেম আর কোন ভাবেই ঠেকানো সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনে মরবে, কিন্তু রাকেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা নীশিতার পক্ষে সম্ভব নয়। উপায় না দেখে রবিন রাকেশের শরণাপন্ন হয়। তাদের চমৎকার ভালবাসার সম্পর্ক, রবিনের প্রতি সাময়িক ক্ষোভের কারণে নীশিতা রাকেশের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে, তাদের সন্তান, পরিবার, পারিবারিক সমস্যা সবকিছু বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু পরকীয়ায় আসক্ত অন্ধ প্রেমিক প্রেমিকাকে বুঝানোর সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। তাই যা হবার তাই হবে। হয়তো নীশিতা ও রবিনের সংসারটা ভেঙ্গে যাবে বা খুনাখুনি র পর্যায়েও চলে যেতে পারে। সুতরাং প্রিয় পাঠক আপনারা নিজেরাই পরবর্তী ঘটনা বা কাহিনী কি কি হতে পারে তা অনুধাবন করে নিন।
কেস স্টাডি ৩ : জামিন সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। অনেকগুলো ইন্ড্রাস্টির মালিক। দিন-রাত টাকা-পয়সা ও ব্যবসার চিন্তা ভাবনা ছাড়া আর কিছুই বুঝেন না। মিসেস জামিনকে তার সব কোম্পানির ৫০% শেয়ার হোল্ডার ও মালিকানার অংশীদার হিসেবে উইল করেছেন। ২৫ বছরের বিবাহিত সুখের সংসার, দুই মেয়ে ও এক ছেলে সবাই বড় হয়েগেছে। ছেলে মেয়েরা সবাই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। উন্নত জীবন যাপনের জন্য দেশে-বিদেশে কয়েকটি বাড়ি করেছেন তিনি। ব্যবসায়িক কাজে জামিন সাহেবকে প্রায়ই ইউরোপ আমেরিকা যেতে হয়। সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী দুই তিন মাসের জন্য দুবাইয়ের বাড়িটিতে আছেন। মেয়েরা খেয়াল করেছে মা যেন ইদানীং কেমন জানি হয়ে যাচ্ছেন। ওদের প্রতি মায়ের কোন মনোযোগই নেই। অনেক দিন ধরেই মায়ের মোবাইলের প্রতি বেশ মনোযোগ দেখা যাচ্ছে। মায়ের বিষয় তাই এসব নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তারা নিজেরাও ব্যস্ত। মা নিজের মত করে একটু ব্যস্ত থাকলে তাতে ক্ষতি কি? কিন্তু দুবাই এর এই অবকাশ-যাপনে মায়ের চলাফেরা গতিবিধি তাদের কাছে অন্য রকম ঠেকে। সর্বনাশা ফেসবুক, মেসেঞ্জারে চ্যাটে ডুবে থাকে মা। আর কার সাথে কথাবার্তা বলা শেষ করে মা প্রায়ই বাসা থেকে বের হয়ে যান। বের হবার সময় বলে যান, আমি জরুরি কাজে বের হচ্ছি বা শপিং এ যাচ্ছি। তোমরা তোমাদের মত খেয়ে দেয়ে নিবে এবং বাসার খেয়াল রাখবে। মেয়েরা যেহেতু বড় হয়েছে, তারা অতটা অবুঝ নয়। মায়ের বলে এতদিন বিষয়টি গুরুত্ব দেয় নি। একদিন মা বাহিরে থাকা অবস্থায় মেয়েরা তার বাবাকে ফোন দেয়। বাবাকে সবকিছু খোলে বলে। মাকে এই মুহুর্তে ভিডিও কল দিয়ে কোথাই আছে চেক করতে বলে। যা হওয়ার তাই হল। মা ফোন পিক করেননি, কিভাবেই বা করবে! পরকীয়ায় আসক্ত মিসেস জামিন তখন তার অর্ধেক বয়সি বয়ফ্রেন্ডের সাথে যে ছিল। রাতেই জামিল সাহেব ইউএসএ টু দুবাই ডাইরেক্ট ফ্লাইটে চলে আসেন। যখন তিনি বাসায় পৌঁছেন তখনও তার প্রিয়তমা স্ত্রী বাসায় ফিরেন নি। তিনি সন্তানদের লাগেজ গুছিয়ে ফেলতে বলেন। সন্তানদের বলেন, আগামীকালই আমরা ইউএসএ চলে যাবো। স্ত্রী বাসায় ফিরেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন হঠাৎ না বলে চলে আসার কারণ। জামিন সাহেব মাথা ঠান্ডা রেখে স্ত্রীর কাছে সব কিছু জানতে চান। স্ত্রী স্বীকার করেন এবং স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে প্রেমিককে বিয়ে করতে চান। জামিন সাহেব অবাক হয়ে যান। ২৫ বছরের বিবাহিত সুখের জীবন, বিয়ের আগে দুজন-দুজনকে প্রচন্ডরকম ভালবেসে বিয়ে করেন। কোন ভাবেই জামিন সাহেব মিলাতে পারেননা যে, এটা কিভাবে সম্ভব!
দেশে থাকতেই মিসেস জামিনের সাথে দুবাই এর এই যুবকের সাথে ফেসবুকে পরিচয়। মেসেঞ্জারে দিন রাত চ্যাটিং এবং পরবর্তীতে গভীর প্রেম। দুবাইতে জামিন সাহেবের বাড়ি কেনার কথায় মিসেস জামিন মহা খুশি হয়েছিলেন। জামিন সাহেবও খুশি হয়ে ছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর মহা খুশি দেখে। এবং দ্রুত দুবাই এর বাড়িটি কিনেন। ফলশ্রুতিতে যুবকের সাথে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাতের কারণে মিসেস জামিন প্রেমে অন্ধ হয়ে যান। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে নিজের ও পরিবারের মানসম্মান, পারিবারিক স্ট্যাটাস সবকিছু ভুলে যান। জামিন সাহেবের করার মত কিছুই থাকে না। স্ত্রীকে কোন ভাবেই বুঝাতে পারেন না। ফেরাতেও পারেন না। ভয়ভীতি মার-ধোর কোনকিছুতেই কিছু হয় না। শেষ পর্যন্ত জামিন সাহেব যুবকের সাথে দেখা করেন। এসবের মানে কি জানতে চায়..! যুবককে বু্ঝাতে গেলে ওল্টা যুবকটি জামিন সাহেবকে জ্ঞান দেয় এই বলে যে, প্রেম অন্ধ, প্রেম মহান, প্রেম সমাজ, সংসার, বয়স, বাঁধা, কোনকিছুই মানে না, জানে না। আমি যদি তাঁকে ( মিসেস জামিন ) সত্যিকার ভাল না বাসতাম তবে তিনি আপনাকে ছেড়ে আমাকে গ্রহণ করার কথা চিন্তা করতেন না! এদিকে ঘৃণাই স্ত্রীর প্রতি জামিন সাহেবের বিন্দুমাত্র ভালবাসা অবশিষ্ট নেই, শুধুমাত্র সংসার বাঁচাতে, সামাজিক স্ট্যাটাস ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে এবং সহায় সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা তার স্ত্রীর নামে এইসব কারনে স্ত্রীকে ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয় না। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চল্লিশোর্ধ একজন মহিলা পঁচিশোর্ধ এক যুবকের সাথে পরকীয়ায় লীপ্ত হয়ে সমাজ- সংসারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্ধপ্রেমে জড়িয়ে যান। অথচ যুবকটির কি সত্যিই মহিলার প্রতি অন্ধ ভালবাসা ছিল নাকি মহিলার সম্পত্তির লোভে অকৃপণ ভালবাসার অভিনয় করে গেছে।
মিসেস জামিন হয়তো জামিন সাহেবের ভালোত্ব দেখেছেন কিন্তু এ বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক জামিন সাহেব যে কত নিষ্ঠুরও হতে পারেন তা তিনি কল্পনাও করেন নি। তাই এ গল্পটিতে আমরা মিসেস জামিনকে রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যু এবং যুবকটিকে আততায়ীর গুলিতে নিহত হতে দেখতে পারি। এবং পরবর্তীতে একটি গোছানো পরিবারের দুর্বিষহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থাটি কিরুপ হতে পারে তা আমি আমার প্রিয় পাঠকদের কল্পনায় অনুমান করে নেবার অনুরোধ জানাচ্ছি।
কেস স্টাডি ৪ : মোনা ও সাকিবের পরিচয় ফেসবুকে। দু’জনই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মোনা বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। যখন যা চেয়েছে তার কোনো আবদারই অপূরণ রাখেনি তার বাবা-মা। অত্যন্ত নামিদামী উচ্চশিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে মোনা। অন্যদিকে সাকিব নিম্ন মধ্যবিত্ত লো’ ক্লাস ফ্যামিলির বাজে ছেলে। সে যেখানে বসবাস করে সেখানে প্রতিনিয়ত দেখেছে মারামারি, খুন-ধর্ষণ, প্রতারণার ছড়াছড়ি। ওরকম পরিবেশেই সাকিব বড় হয়েছে। সুতরাং তার ভিতর জগত টা ওভাবেই গড়ে ওঠা।
বিভিন্নভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এদিকসেদিক করে সাকিব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশনের সাহস করে এবং ভালভাবেই বিভিন্নভাবে টিউশন ফি পরিশোধ করে যাচ্ছে। এবং ওর চলাফেরায় বুঝার উপায় নেই যে সে একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাজে পরিবারের ছেলে। টিউশন ফি চালিয়ে নেবার জন্য সে একেকসময় একেক ফন্দি বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
মোনার সাথে ফেসবুকে পরিচয় হবার পর সে জানতে পারে তারা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পরবর্তীতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সারাদিন বেড়াতো আর সারারাত মেসেঞ্জারে চ্যাটিং। কিছুদিনের মধ্যেই সম্পর্ক গভীর হয়। আর সম্পর্কের গভীরতার কারণে আবদার চাহিদাও দ্বিগুণ বেড়ে যায় পরবর্তীতে রাতে চ্যাটিং এর সময় ভিডিওকলেই মোনাকে সম্পূর্ণরুপে উলঙ্গ দেখতে চায় সাকিব। রাজি না হলে অভিমান দেখায়। প্রেমের নামে অপ্রেমের আবদারের শিকার হয় মোনা। এক এক করে সবকিছু দেখায় সাকিবকে। আর সুন্দরভাবে সবকিছুর স্ক্রিন শট নেয় সাকিব। তারপর সে ছবিগুলো ফেসবুক ও সব জায়গায়, মোনার পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠাবে, ভাইরাল করে দিবে এসব বলে বলে ভয় দেখিয়ে কয়েক মাস ধরে প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা আদায় করেছে মোনার কাছ থেকে । মোনা নিজের টিউশন ফি না দিয়ে, আলমারি থেকে টাকাপয়সা চুরি করাসহ নিজের যত অর্নামেন্ট আছে সব সাকিবের হাতে তুলে দিয়েছে। সাকিবকে মিনতি করে আমার দ্বারা আর সম্ভব নয় কিন্তু সাকিব যে রক্তের স্বাদ পেয়েছে তা ভুলা সম্ভব নয়, তাই ওর আরো আরো টাকা চায় সাথে মোনাকে পণ্যের মতো ব্যবহার করা। এখন মোনা কি করবে? আত্ম হত্যা নাকি অন্য কিছু???
কেস স্টাডি ৫ : নিম্মি একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। বাবা-মা সেপারেট। বাবাও অন্য মহিলাকে বিয়ে করে নতুন সংসার করছে আর মাও অন্য পুরুষকে বিয়ে করে নিজের পথ বেছে নিয়েছে। মাঝখানে সে একা। মা বা বাবা কেউ নিম্মির দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক নয় তাই শেষ পর্যন্ত নিম্মির ঠাই হলো হোস্টেলে। বাবা-মা খুব একটা তাকে দেখতে আসে না তবে সময়মত টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ইদানীং এ দায়িত্বও ঠিকমত পালন করছে না তার বাবা-মা। এরকম বৈরি পরিবেশে বড় হবার কারণে নিম্মি অল্প বয়সেই যথেষ্ট মেচিউরড হয়ে গেছে। সে এখন আতংকিত। বাবা – মা যদি তার খরচ বিয়ার না করে তাকে তো হোস্টেল থেকে বের করে দেবে। সে নিজেকে নিয়ে খুব চিন্তাভাবনা করতে থাকে। সে কি করবে, কিভাবে চলবে বা কিভাবেই বা পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। এরমধ্যে সিমন নামের সমবয়সী একটি ছেলের সাথে তার ফেসবুকে টুকিটাকি কথাবার্তা, দুষ্টামি হয়। সিমন অত্যন্ত সরলসোজা, ভদ্র ও বোকা টাইপের ছেলে। ওরা দু’ জনই এইচএসসি পরীক্ষার্থী । মাত্র দুমাসের পরিচয়ে নিম্মি সিমনকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হবার পরের দিনই তারা বিয়ে করে বসে। সিমনের মায়ের গগন ফাটানো আর্তচিৎকার, কান্না – আহজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে যায়। এত আদরের বড় ছেলেটির কর্মকান্ডে বাবা স্ট্রোক করে বসেন। পরিবারটি নিজেদের ধংসের মুখেও ছেলের আবদারের কারণে নিম্মি নামক ধূর্ত, অতি চালাক, পরিবারহীন, ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়েটিকে ঘরে তুলে নিতে বাধ্য হোন। আর এভাবে আরেকটি সুন্দর পরিবারও দুঃখযন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যায়।
কেস স্টাডি ৬ : একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলে একটি হিন্দু মেয়ের সাথে নিরুদ্দেশ। সম্পর্ক ফেসবুকের মাধ্যমে। বাবা- মা থানায় ডায়েরি করতে এসেছেন। ওসি সাহেব বললেন, বাচ্চাদের হাতে স্মার্ট ফোন দিয়েছেন কেন? উত্তরে বাবা নির্বিকার। বলে আমরা আজ আমাদের সন্তানদের হাতে জিম্মি। ওদেরকে কি শাসন করবো, ওরাই উল্টা আমাদের শাসন করে!…………
এরকম হাজারো কাহিনী আছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। প্রেমের নামে অপ্রেম, নোংরা সম্পর্কে জড়ানো বা পরকীয়া প্রেম এগুলো যুগে যুগে ছিল, আছে কিন্তু ফেসবুক, মেসেঞ্জারের সহজলভ্যতা, যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে এ ধরণের বিষয়গুলো এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
তাই আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনে চলতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার পরিবেশে সন্তানদের বড় করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তানাদির প্রতি আরো বেশি বেশি মনোযোগ দেওয়া, নিজেদের আত্ম কেন্দ্রিকতা থেকে দূরে সরিয়ে পরিবার-পরিজনদের বেশি বেশি সময়-মনোযোগ দিয়ে এ ক্রান্তিকাল বা ক্রান্তিলগ্নের মোকাবেলা করতে হবে।
______________________________
কলাম লেখক : মাহবুবা সুলতানা শিউলি
মেম্বার, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।