কক্সবাজারে (টেকনাফ-উখিয়া) আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি সরকারি তালিকায় মাদক চোরাচালানের পৃষ্ঠপোষক। কথিত আছে, বদি ও তার ভাই-ব্রাদারদের ইশারায় মিয়ানমার থেকে দেশে ঢোকে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা-আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) চালান। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের ১০ দিনের মাথায় সেই বদি গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। তার ভাই-ব্রাদাররাও আত্মগোপনে। তবে দেশে ইয়াবা-আইসের চালান আসা বন্ধ হয়নি।
বদি কারাগারে থাকলেও মাদকের চালান আসা যে বন্ধ হয়নি, সেই তথ্য মেলে টেকনাফ মডেল থানার মামলার পরিসংখ্যানেও। থানার তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে বিভিন্ন সংস্থা ২৪ লাখ ১৫ হাজার ৭২০ পিস ইয়াবা ও প্রায় পৌনে ৫ কেজি আইস উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় টেকনাফ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে ১৭১টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ২২৭ মাদক কারবারি। অবশ্য মামলাগুলোতে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা ২৯০ জন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘মাদক আসে সীমান্ত দিয়ে, এটার বিষয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বলতে পারবে। এখানে পুলিশের কিছু করার নেই।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বদির নাম থাকলেও ওই তালিকাতেই মাদকের গডফাদার হিসেবে তার চার ভাইসহ পরিবারের অন্তত ২৬ জনের নাম ছিল। মাদক রাজ্যে এই পরিবারের ‘পতন’ সাদা চোখে দেখা গেলেও এদের প্রভাব যে রয়ে গেছে এখনো—তা বোঝা গেল টেকনাফের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে। পাশাপাশি বদি পরিবারের অনুপস্থিতিতে মাদক পাচারের নাটাই নিয়ন্ত্রণে যে অন্য গডফাদার সৃষ্টি হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা গেলেও বরাবরের মতো মুখ খোলেননি স্থানীয়দের কেউ।
কক্সবাজারে র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘মাদক চোরাচালান একজনে করে না, এটার জন্য গ্রুপ আছে। একজন না থাকলে বা কেউ আত্মগোপনে গেলে রাতারাতি এই অবৈধ কারবার থামবে না, এটা স্বাভাবিক। কারণ নতুন করে চোরাকারবারিরা তাদের চেষ্টা চালাবে। তবে র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেমে নেই। প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে, মাদক জব্দ হচ্ছে। কারবারিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে ৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে এই অবৈধ কারবারে অনেকে জড়িত। যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই নজরদারি করা হচ্ছে এবং আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে।
টেকনাফের ‘ইয়াবা হাটের’ ইজারা এখন কার হাতে সেই তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেল—বদি ও তার ভাই-ব্রাদাররা না থাকলেও তাদের ছায়াটা রয়ে গেছে। এক সময়ে তাদের হয়ে যারা মাদক পাচারে সরাসরি যুক্ত ছিল, তাদের কেউ কেউ এখন গডফাদাররূপে ফিরেছে। তবে বরাবরের মতো রাঘববোয়ালরা রয়ে গেছে আড়ালে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সরকারের আহ্বানে কক্সবাজারের ১০২ জন এবং আরও ২১ জন মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করে। সে সময় তাদের কারাগারে পাঠানো হলেও গত কয়েক বছরে তারা জামিনে বের হয়েছে। গত পাঁচ বছরে তাদের কয়েকজন মারা গেলেও এখন সময়ের পরিবর্তনে আত্মসমর্পণ করা অনেকেই মাদকের কারবারে ফিরেছে।
সম্প্রতি টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে মাদক কারবারিদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়। স্থানীয় লোকজন নানা বিষয়ে তথ্য দিলেও আতঙ্কে কেউ সরাসরি মুখ খুলতে চান না, নিজের নাম-পরিচয়ও দিতে চান না। তাদের ভাষ্যে বেরিয়ে আসে, এক সময়ে ইয়াবা পাচারে ‘রাখঢাক’ থাকলেও এটা এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই চলে। কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, ‘ক্রসফায়ার’কে এক সময়ে মাদক কারবারিরা ভয় পেত, সেই ভয়টা এখন আর নেই। তা ছাড়া এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও আগের মতো আর নেই।
টেকনাফের লোকজনের ভাষ্য, ইয়াবা ও আইস আসে মিয়ানমার থেকে। আগে টেকনাফ লাগোয়া মিয়ানমার সীমান্ত দেশটির জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং শান্তিপূর্ণ ছিল সীমান্ত পরিস্থিতি। কিন্তু ওপারের পুরো সীমান্তই এখন মিয়ানমারের আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে এই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার স্থানীয়দের অনেকটা অবাকই করে।
ইয়াবা-আইস পাচার রুটের নিয়ন্ত্রক কারা: কক্সবাজার ও টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা এবং স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, টেকনাফ সীমান্তে ঘুরেফিরে পুরোনো কারবারিদের হাতেই মাদক পাচারের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে। তবে এর নেপথ্যে নাটাই নাড়ছে নতুন হোতারা। এই হোতাদের বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি শুরু হয়েছে।
এক সময়ে আত্মসমপর্ণ করে ‘স্বাভাবিক জীবনে ফেরা’ অনেক কারবারি ফের ইয়াবার কারবারে ফিরেছে—এমন প্রশ্নে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, বলেন, ‘এদের আমরা সব সময়ে নজরদারিতে রাখি, যাতে এরা ফের মাদকের কারবারে জড়াতে না পারে। তা ছাড়া এদের বিরুদ্ধে বিচারও চলমান রয়েছে।’
কক্সবাজার ও টেকনাফ ঘুরে সংশ্লিষ্ট নানা সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মাদক পাচারের নাটাই এখন টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা একরাম হোসেন, মো. জামাল ওরফে জামাল মেম্বার, শামসুল আলম ওরফে শামসু মেম্বার, মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল হুদা ওরফে নুরুল মেম্বার, দিদার মিয়া, সাহেদ রমান নিপু, নুরুল আমিন, এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, আবদুর রহমান, শাহ আলম, শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, ফয়সাল রহমান, মোজাম্মেল হক, নুরুল বশর ওরফে নুরশাদ, কামরুল হাসান রাশেদ, জিহাদ, মোহাম্মদ শাহ, আফসার, রবিউল আলম, আবু সৈয়দ, মো. তাহের, মো. আলম, মিজান, আবদুল্লাহ, আবদুল কাদের ও মো. জুয়েলের হাতে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। এ গ্রুপটি এক সময় আত্মসমর্পণ করলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের মাদকের কারবারে ঢুকেছে। তাদের হয়ে শতাধিক লোক ইয়াবা ও আইস সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করাচ্ছে।
সূত্র জানায়, এই ২৭ জনের মধ্যে শামসুল আলম ওরফে শামসু মেম্বার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কক্সবাজার ও টেকনাফে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে স্থানীয়রা তাকে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছে। সফিক ও ফয়সাল আবদুর রহমান বদির সৎ ভাই। শাহেদ রহমান নিপু আবদুর রহমান বদির ভাগ্নে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা আত্মগোপনে গেলেও নিজস্ব বাহিনী দিয়ে মাদকের পাচার অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে।
রোহিঙ্গাদের সহায়তায় সহজ হচ্ছে মাদকের পাচার: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মাদক পাচারের রুট নিয়ন্ত্রকদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নিজেদের অবৈধ কারবার চালাচ্ছে। তাদের এই কাজে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও ডাকাত দলের সদস্যরা সহায়তা করছে।
সূত্রগুলো বলছে, নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের এইচ ব্লকের ডাকাত কামাল, শফি, সাদ্দাম হোসেন, মোহাম্মদ সাদেক, মোহাম্মদ রফিক ওরফে আব্বুয়া, হালা বাশি, সেফায়েত উল্লাহ ওরফে বুড়িংঙ্গা, ইজ্জত আলম, মনজুর আলম, বাবুল, ইসাক, মোহাম্মদ শফিক, হাবিবুর রহমান ওরফে হাবি, মোহাম্মদ ফারুক, মোহাম্মদ সিদ্দিক, রবি আলম, সৈয়দুল্লাহ, নুর হাসিম ওরফে আব্বুয়া, মোহাম্মদ কাসিম, মোহাম্মদ জুবাইর ওরফে কালাবাসি, মোহাম্মদ রফিক ওরফে চইক্কা রফিক, আবছার ওরফে অল কাটা আবছার ও মতলব টেকনাফের মাদককারবারিদের সহায়তা করে আসছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ কালবেলাকে বলেন, ‘টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক পাচারে আগের গ্রুপ না থাকলেও এই কারবার থেমে থাকে না। যারা আগের কারবারিদের শূন্যতা পূরণ করে এই কারবার করছে, আগের গ্রুপের সঙ্গে এদের লিঙ্কটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
যাচ্ছে ভোগ্যপণ্য, আসছে মাদক: টেকনাফের বাসিন্দারা বলছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার সময়ে অবাধেই মাদক ঢুকত টেকনাফে। তখন হুন্ডিতে টাকা পাঠিয়ে মাদক পাচার করা হতো। মিয়ানমার সীমান্তে জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ শুরু হলেও সেখান থেকে মাদক পাচার থামেনি। মিয়ানমার সীমান্ত বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর ওই পাড়ে প্রচণ্ড খাদ্য সংকট চলছে। টেকনাফের মাদক পাচারকারীরা ওই পাড়ে ভোজ্য তেলসহ নিত্যপণ্য পাচার করে বিনিময়ে ইয়াবা আনছে।
টেকনাফ সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এক সময় মাছ ধরার ট্রলার বা নৌকায় মাদক মিললেও এখন মাঝেমধ্যেই পণ্যবাহী বোট বা নৌকায় মিলছে ইয়াবাসহ নানা মাদক। এসব বোটে পাচার করে খাদ্যপণ্য ওপারে পৌঁছে দেয় সিন্ডিকেট সদস্যরা। বিনিময়ে তারা মাদক নিয়ে আসে। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম নৌঘাট এলাকায় একটি তেলের গ্যালন থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করে র্যাব।
পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’—এমন স্লোগান দিয়ে শুরু হওয়া ওই অভিযান ছিল মূলত ইয়াবার ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে খ্যাত কক্সবাজারের টেকনাফকেন্দ্রিক। ওই সময়ে মাদক উদ্ধার ও মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চললেও একের পর এক বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ঘটতে থাকে। বহুল আলোচিত ওই অভিযান শুরুর পর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চার নারীসহ ২৯৯ জন নিহত হন। তাদের মধ্য ১৭৪ জনই নিহত হন টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ স্থানীয় কাউন্সিলর একরামুল হকের নিহতের ঘটনায় দেশজুড়ে এই অভিযান নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এর দুই বছর পর ২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এরপর ওই এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ থাকে। পরে সংখ্যায় কম হলেও মাঝেমধ্যে এমন ‘বন্দুকযুদ্ধে’র খবর আসে। অবশ্য ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর র্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে দেশে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, পুরোনো মাদক কারবারিদের নজরদারিতে রাখার চেষ্টা থাকে। কিন্তু এই কারবারটা তো প্রকাশ্যে কেউ করে না, গোপনে করে থাকে। মাদকসহ কাউকে পাওয়া গেলে তাকেই ধরা হচ্ছে। গডফাদার বা এ ধরনের কেউ তো আর প্রকাশ্যে এটা করে না। বিজিবি, র্যাব ও কোস্টগার্ডসহ সব সংস্থা এই মাদক পাচার ঠেকাতে কাজ করছে। সুত্র, কালবেলা