দেশে উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকার চুরি হচ্ছে। টিআর-কাবিখায় যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়, সেই টাকা দিয়ে ‘সোনার মসজিদ’ বানিয়ে দেওয়া সম্ভব। আমাদের সম্পদের সমস্যা অথচ সম্পদ ছিটিয়ে দিচ্ছেন! কাকে দিচ্ছেন? টাকা ছিটাচ্ছেন একজন আমলাকে বড়লোক করার জন্য? একজন এমপিকে বড়লোক করার জন্য? উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বড়লোক করার জন্য? এসব না দিয়ে তালিকা করে প্রয়োজনীয় লোকদের রেশন দেয়া হলে চুরিটা বন্ধ হবে। স্টাফ রিপোর্টার : দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্পের অর্ধেক যায় এমপিদের পেটে আর ওইসব প্রকল্পে শতকরা ৮০ ভাগ চুরি হয় বলে সরল স্বীকারোক্তি করেছেন জাসদ (ইনু-শিরিন) সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি উন্নয়নের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দের টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের ৮০ শতাংশই চুরি হয়। ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলে ১৫০ কোটি টাকা (অর্ধেক) যায় এমপিদের পকেটে। বাকি ১৫০ কোটি টাকার সিংহভাগ যায় স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পকেটে। আমরা চোখ বন্ধ করে এ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছি।’ গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পিকেএসএফ ভবনে ‘গ্লোবাল সিটিজেনস ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সামিট-২০১৬’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সব এমপিই হয়তো চুরি করেন না, কিন্তু বেশিরভাগ এমপিই এ কাজটি (টিআর, কাবিখার গম-চাল-টাকা চুরি) করেন। এ জন্য উন্নয়ন বাজেটের অর্থ সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের বাজেটে দেওয়া উচিত। এতে উন্নয়ন বৈষম্য কমে আসবে। পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ সামিট-২০১৬-এর আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মনজুরুল ইসলাম ও বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আব্দুল মোমেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এমিনেন্স আ্যসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং গ্লোবাল সিটিজেনস ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের সচিব ড. শামীম হায়দার তালুকদার। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন আজ সোমবার সমাপ্ত হবে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায়ের সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, সুশীল সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তুলে ধরা। এ সম্মেলনের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ, সর্বোত্তম কার্যাভ্যাস সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে এবং বিভিন্ন দেশভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিরীক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু সুপারিশমালা সংজ্ঞায়িত করা হবে। সম্মেলনে বিভিন্ন আলোচনা ও উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও অগ্রগতির ধারা পর্যবেক্ষণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মপরিকল্পনায় সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র সুপারিশ করা হবে। সম্পদের সাম্যভিত্তিক সুষ্ঠু বণ্টন ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সুশীল সমাজ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক স্থাপনের পথ সুগম করা এ সামিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সম্মেলনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রধান ৬টি প্রতিপাদ্য হলোÑদারিদ্র্য ও ক্ষুধার সমাপ্তি, সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা এবং সব বয়সের সবার জন্য মঙ্গল প্রচার, সমন্বিত ন্যায়সঙ্গত ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, সকলের জন্য টেকসই পানি ব্যবস্থপনা ও তার প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ, প্রাণবন্ত, টেকসই শহর ও জনবসতি গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। হাসানুল হক ইনু বলেন, উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকার চুরি হচ্ছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়, সেই টিআর অর্থ দিয়ে সোনার মসজিদ বানিয়ে দেওয়া যায়, এত টাকা। এই দুর্নীতি বন্ধে প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে পল্লী রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি অর্থমন্ত্রীর কাছে জানিয়ে ইনু বলেন, আমাদের সম্পদের সমস্যা, অথচ সম্পদ ছিটিয়ে দিচ্ছেন! কাকে দিচ্ছেন? একজন আমলাকে বড়লোক করার জন্য? একজন এমপিকে বড়লোক করার জন্য? উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বড়লোক করার জন্য? তালিকা করে প্রয়োজনীয় লোকদের রেশন দেন। তাহলে চুরিটা তো বন্ধ হবে। বৈদেশিক সহায়তাসহ বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারার প্রসঙ্গ তুলে তথ্যমন্ত্রী অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে ইউনিয়ন পরিষদকে সরাসরি বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করেন। হাসানুল হক ইনু বলেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে। এজন্য সাধারণ মানুষের বাজারে ঢোকার প্রবেশগম্যতা, ক্ষমতার কাঠামো প্রবেশগম্যতা, মানবসম্পদের ক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশগম্যতা, সম্পদের কাছে যাওয়ার প্রবেশগম্যতা বাড়াতে হবে। কোনো দেশে কয়জন প্রধানমন্ত্রী নারী হলেন বা কয়জন এমপি, স্পিকার বা বিরোধীদলীয় নেতা নারী হলেন, তার ওপর ভিত্তি করে নারীর ক্ষমতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা যায় না। বর্তমান সরকারের বাজেটে দিকবদল ঘটার দাবি করলেও তার দর্শন অর্থমন্ত্রী মুহিত স্বীকার করছেন না উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, গত সাত বছর ধরে মুহিত ভাই বাজেট দিচ্ছেন। বাজেটে অতীতের থেকে একটা দিক বদল হয়েছে। সমাজের চাহিদাকে আপনি স্বীকার করছেন, রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় বৃদ্ধি করেছেন, ব্যক্তি উদ্যোগকে আরেকটু উৎসাহিত করেছেন এবং বাজারশক্তির স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটা দিক বদল। কিন্তু এ দিক বদলটা কেন করলেন আপনি? এর দর্শনটা কী? সেটা তো এখানে লিখলেন না। লজ্জা লাগল? ইউরোপের টনি ব্লেয়ারদের তো লজ্জা লাগে না। আপনি তো বহুত বড়াই করে বলেন, চার নীতিতে ফেরত গেলাম। সে চার নীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, আরেকটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, আপনি খালেদা জিয়া ও সামরিক শাসকদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থেকে একটা দিক বদল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আপনি এ দিক বদল করেছেন। সামাজিক খাতে আপনি বিনিয়োগ বেশি করেছেন। গ্রামের জন্য বেশি বরাদ্দ দিচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বেশি বরাদ্দ দিচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতের ওপর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। এই পরিবর্তন আপনি সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করেন, এ জন্য আসছে। আপনি বৈষম্য থেকে বেরোনোর চিন্তা করছেন। তাহলে আপনি সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করেন। কিন্তু আপনার বাজেটের কোথাও বা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কোথাও সমাজতন্ত্র শব্দ নেই। সমাজটাকে অন্ধকারে কেন রাখছেন আপনি? অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদীরা যদি আমি এখানে একটা বর্বর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব বলতে লজ্জা না পায়, তাহলে আমি সমাজতন্ত্র বলতে লজ্জা পাব কেন? তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকরণের কাজও চলছে। তবে সাংস্কৃতিক প্রবৃদ্ধিতে মারাত্মক ঘাটতি আছে। ওই সমাজে বিপর্যয় অনিবার্য, যে সমাজে সাংস্কৃতিক প্রবৃদ্ধিতে ঘাটতি থাকে। মন্ত্রী প্রশ্ন করেন, দেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিনিয়োগ কই? কয়েকটি গান-নাচ হলেই সাংস্কৃতিক বিকাশ হয় না। বিদেশ থেকে কয়েকজনকে নিয়ে এসে শিল্পকলা একাডেমিতে কয়েকটি অনুষ্ঠান করলেই সংস্কৃৃতির বিকাশ ঘটে না। সংস্কৃতির বিকাশ করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ইন্টারনেটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে অনেক চিল্লাচিল্লি করেছি। অর্থমন্ত্রীর কাছে অনেকবার তদবির নিয়ে গেছি, কিন্তু অর্থমন্ত্রী তা শোনেননি। তদবিরে লাভ হয়নি। ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করলে মানুষ সহজে প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে পারত। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের একটি দেশের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি ওই অঞ্চলের একটি দেশ ইন্টারনেট ব্যবহার অধিকার হিসাবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক সুরক্ষাতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়, এমন অভিযোগ করে তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, আগামী ১৫ বছর মেয়াদি ২০১৬-৩০ এসডিজির সূচকগুলো অর্জন করতে চাইলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সামাজিক সুরক্ষাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেনÑআমাদের এখন সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কত? অথচ উন্নয়নশীল দেশে অনেক বেশি। আমাদের বরাদ্দ মাত্র মোট জিডিপির দুই শতাংশ আর বাজেটের ১৩ শতাংশ। এটা আরো বাড়াতে হবে। ভিক্ষুকদের নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তথ্যমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে আমরা তিনটি যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে জঙ্গি দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য উন্নয়ন যুদ্ধ। তিন নম্বর যুদ্ধ হচ্ছে দলবাজি, ক্ষমতাবাজি, দুর্নীতি, দলীয়করণ পরিহার করে সুশাসনের যুদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক ‘প্রবৃদ্ধিও’ অব্যাহত রাখতে হবে। কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আমরা এমডিজি বাস্তবায়ন করেছি নিজস্ব অর্থায়নে। বিদেশ থেকে টাকা পাইনি। উন্নত বিশ্ব অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবায়ন করে না। আমাদের মধ্যে অনেক ধান্ধাবাজ তৈরি হয়। যারা আন্তর্জাতিক পরিম-লে গিয়ে নিজ দেশের পক্ষে কথা না বলে যারা টাকা দেয়, তাদের পক্ষে কথা বলে। যারা এসব ধান্ধাবাজি করে, তাদেরকে ধান্ধা ছাড়ার পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, টেকসই উন্নয়নের ১৭ এজেন্ডার মধ্যে জঙ্গিবাদ দমনকে একীভূত করতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। স্বাস্থ্যসচিব মনজুরুল ইসলাম বলেন, ২০০০ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। ১৫ বছর পর এখন দেখা যাচ্ছে, এমডিজি অর্জনে বিশ্বে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, গড় আয়ও। একই সঙ্গে মাতৃমৃত্যুহারও কমেছে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নে বেশ চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমাদের সম্পদ নয়, দক্ষ জনবল ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
Copyright Daily Inqilab
পাঠকের মতামত