পর্যটন জেলা কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেললাইন চালু হওয়ার আগেই একবার পাহাড়ি ঢলে বেঁকে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে রেলওয়ে কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের ঘুম ভাঙেনি। সাতকানিয়া এলাকায় রেললাইন ঘেঁষে ইটভাটার জন্য মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে বিশালাকারের অনেক জলাশয়।
এতে রেললাইনটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে রেললাইনের মাটি সরে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে রেললাইন রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশও উপেক্ষা করা হচ্ছে।
সাতকানিয়া উপজেলার ৭৩টি ইটভাটার মধ্যে অনেকগুলো অবৈধ। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা সবাই মাটি কাটার বিরুদ্ধে। তবুও দেদার কাটা হচ্ছে মাটি। কেউ কেউ মাটির চাহিদা মেটাতে কোপ দিচ্ছে পাহাড়েও।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মৌলভীর দোকান থেকে কেঁওচিয়া ইউনিয়নের আঁধার মানিক দরগাহ লাগোয়া কেরানিহাট লেভেলক্রসিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক সময়ের তিন ফসলি কৃষিজমির মাঠ এখন বিশালাকৃতির জলাশয়।
কেঁওচিয়া ইউনিয়নের নয়াখাল, পাঠানিপুল ও আঁধার মানিক দরগার পশ্চিমে ঢেমশা এলাকায় দেখা গেছে, মাটি খননের ফলে সৃষ্ট জলাশয় থেকে পুনরায় মাটি কাটার জন্য পাম্প বসিয়ে জলাশয় থেকে পানি তুলে দেওয়া হচ্ছে। এলাকার হাজারও গ্রাহকের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ না করে মিটারবিহীন পানির পাম্প বসিয়ে বিশাল জলাশয় সেঁচে মাটিখেকোদের পুনরায় মাটি কাটার উপযোগী করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দোহাজারী বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে।
তবে দোহাজারী বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, জলাশয়গুলো থেকে মাছ ধরার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে, শুকিয়ে মাটি কাটার জন্য নয়।
উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ঢেমশা বারি সিকদার পাড়ার কৃষক আবু জাহের সিকদার বলেন, ব্রিটিশ আমলের আগে থেকে আমাদের বাপ-দাদারা রেলওয়ের অধিগ্রহণ করা জমি ও পাশের জায়গায় চাষাবাদ করে পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতেন। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার পাঁচ কানি জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে। তখন ভয়ে জায়গায় যেতে পারিনি। এখনো একইভাবে মাটি কাটা হচ্ছে।
একই চিত্র তুলে ধরেছেন, কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু সৈয়দ। তিনি বলেন, রেললাইন সংলগ্ন তার মালিকানাধীন কৃষিজমির মাটি রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। প্রশাসনকে পাত্তা না দিয়ে অবিক্রীত জমির মাটি জোর করে কেটে নিয়ে গেছে। প্রথম দিকে মহাসড়কের দক্ষিণ পাশের জমির মাটি কেটে জলাশয়ে পরিণত করেছে। বর্তমানে উত্তর পাশের কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে অভিযোগ করেছেন কালিয়াইশ ইউনিয়নের রসুলাবাদ এলাকার মো. ওসমানসহ আরও অনেকে।
ঝুঁকিতে পড়ছে রেললাইন
২০২৩ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু করার আগে পাহাড়ি ঢলে বেঁকে যায়। তবে লাইনের গোড়ায় মাটি থাকায় পুরো লাইন বিধ্বস্ত হয়নি। সেই ঘটনাকে সতর্ক বার্তা হিসেবে গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন এবং রেলওয়ে। প্রতিরাতে ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইনের প্রায় কাছাকাছি দুই পাশে গভীর করে কৃষিজমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়েরও কোনো মাথাব্যথা নেই।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম (পূর্ব) এর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, রেললাইন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা হবে, রেললাইনের কতদূর থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যারা মাটি কাটছে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান তিনি।
সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের চনখোলা গ্রামের চূড়ামণি এলাকায় খাজা থ্রি নামের একটি ইটভাটা দিনদুপুরে পাহাড় কেটে সে ওই মাটি দিয়ে ইট তৈরি করছে। এ ছাড়াও চূড়ামণি গ্রামের বেশির ভাগ ইটভাটায় ইট তৈরিতে পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় দলীয় পদবি ও নামধারী অনেকেই কৃষিজমির টপ সয়েল কাটার কাজে জড়িত ছিল। তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল অন্য দলের অনেক নেতা-কর্মী ও সমর্থক। সে সময় তারা নিজেদের আড়ালে রাখতেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের আমলে আড়ালে থাকারাই এখন সামনে চলে এসেছেন। আর ওই সময় যারা সামনে ছিলেন তারা আড়ালে চলে গেছেন।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সম্প্রতি সাতকানিয়া থানায় যোগদান করেছি। কোথাও কৃষিজমির মাটি কাটার অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেব।’