দেড় বছর আগে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আইএসবিরোধী সৌদি জোটে যোগ দিলেও লড়াইয়ের মাঠে যাবে না বাংলাদেশ। এই অবস্থান স্পষ্টই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও ওই জোটের গবেষণা, তদন্তকাজসহ মাঝারি স্তরে বাংলাদেশ থেকে জনবল নিয়োগ করতে চাইছে সৌদি সরকার। পাশাপাশি তাদের ভূখণ্ড থেকে মাইন অপসারণ, সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা অবকাঠামোর বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইছে সৌদি আরব।
ঢাকা ও রিয়াদের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে গত বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করছে। বিশেষ করে মাইন অপসারণ, সীমান্ত রক্ষাসহ অবকাঠামোর উন্নয়নে সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়েও সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে সৌদি কর্তৃপক্ষের আলোচনা হয়েছে। তেল সমৃদ্ধ দেশটি এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতা পেতে আগ্রহী।
আইএসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে অবস্থান নিতে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে নিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দ্য ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্সের (আইএমএ) ঘোষণা দেন সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান আল সউদ। আনুষ্ঠানিকভাবে দ্য ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম (আইএমএএফটি) নামে পরিচিত সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ৩৪টি দেশকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরে জোটের সদস্যসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪১। এ বছরের জানুয়ারিতে আইএমএএফটির প্রথম কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ পান পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) রাহিল শরিফ। ওই জোটে পাকিস্তানের পাঁচ হাজার সৈন্যের যোগ দেওয়ার কথা।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিলের প্রথমার্ধে রিয়াদ সফরের সময় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে সৌদি সেনা কর্মকর্তাদের আলোচনায় দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে। এ সময় সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে রিয়াদের আগ্রহের প্রসঙ্গটিও এসেছে।
সৌদি সরকার সন্ত্রাসবিরোধী জোটের তদন্ত প্রক্রিয়া ও গবেষণার মতো কাজে বাংলাদেশের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছে। সৌদি আরব তার এই পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশকে জানিয়েছে।
জানতে চাইলে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গত সপ্তাহে রিয়াদ থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করা যায়, এ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাস্তবায়নের পথে যাবে।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে ইয়েমেনে সৌদির নেতৃত্বাধীন অভিযানে বিপুলসংখ্যক শিশুসহ সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর কারণে দেশটির বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া শিয়া-সুন্নি বিরোধের বড় দায়টাও সৌদি আরবের। এমন এক পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কোনো প্রতিরক্ষা উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আগে যথেষ্ট সময় নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রিয়াদের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশ কীভাবে সৌদি আরবকে সহযোগিতা করতে পারে, তা নিয়ে গত সপ্তাহে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন রিয়াদে সৌদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক সৌদি আরবে যান। ওই সময় সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা স্থাপনা নির্মাণ, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, মাইন অপসারণ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজের পরিচর্যা নিয়ে দেশটির সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়। দুই দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়। জুলাই মাসে সৌদি আরবের সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল আয়েশ ঢাকায় এসে সহযোগিতার বিষয়গুলো বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেন।
জানা গেছে, দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য সৌদি আরবের সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান এয়ার মার্শাল ফায়াদ বিন হামিদ আল রুহাইলি গত বছরের আগস্টে ঢাকা সফর করেন। পরের মাসে ঢাকায় আসেন সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের প্রধান।
রিয়াদে কূটনৈতিক সূত্রে যোগাযোগ করে জানা গেছে, উপসাগরীয় যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় মাইন অপসারণের ব্যাপারে বাংলাদেশের দক্ষতা আছে। তবে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সৌদি আরবের সংঘাত চলতে থাকায় সীমান্ত সুরক্ষায় সহযোগিতা কিংবা মাইন অপসারণে অংশ নেওয়ার আগে কোথায় ও কখন কাজ করবে, তা আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার আছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়েমেনে অভিযান শুরুর পর থেকেই সৌদি আরবের ভূমিকার সমালোচনা করে জাতিসংঘে দুবার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে সৌদি আরবের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের উত্থান, ইরানের সঙ্গে বিরোধ—এই সবকিছুর মূলে শিয়া আর সুন্নি বিভাজনকে বড় কারণ বিবেচনা করা হয়। আর এই বিভাজনের জন্য দায়ী করা হয় সৌদি আরবকে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষার কোনো উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার আগে নিজেদের ঝুঁকির মুখে ফেলছি কি না, সেটা প্রথমেই দেখতে হবে। এর পাশাপাশি এমন কোনো প্রয়াসে যুক্ততার চূড়ান্ত সুফল কী, এটাও খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘চিলড্রেন অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট’-এ ইয়েমেনের ৬০ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর জন্য সৌদির নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানকে দায়ী করা হয়। গৃহযুদ্ধকবলিত ইয়েমেনে ২০১৫ সালে প্রাণ হারায় ৫১০টি শিশু আর আহত হয় ৬৬৭টি শিশু। এ জন্য সৌদি আরবকে জাতিসংঘ কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। বাংলাদেশ, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এর প্রতিবাদ জানালে কালো তালিকা থেকে সৌদি আরবের নাম বাদ দেয় জাতিসংঘ। সৌদির নেতৃত্বাধীন ৪১ দেশের সামরিক জোটের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সৌদির জোটে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়াদের অন্য একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ এপ্রিলে সামরিক জোটের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন। দেড় বছর আগে গড়া জোটের ভবিষ্যৎ কোন পথে, অর্থাৎ এটি আদৌ আইএসের বিরুদ্ধে বড় পরিসরে লড়াইয়ের মাঠে নামবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য শরিক দেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে রোজার পর আলোচনায় বসতে যাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি জোটের পরবর্তী কাজের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য মে মাসের মধ্যে সদস্যদেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকের কথা আছে। এখন পর্যন্ত আলোচনার সময়সূচি ঠিক হয়নি। সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বাংলাদেশের লোকজনকে নেওয়ার ব্যাপারে সৌদি আরব যথেষ্ট আগ্রহী।