সাক্ষাৎকার গ্রহণ :শেখ রোকন::
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরো পঞ্চাশের দশকে তার গুরু বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোসহ ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি এর প্রধান। গুরু শুদ্ধানন্দ ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের জন্য দেশের বাইরেও বিপুল সমাদৃত ও সম্মানিত। তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি এবং বিশ্ব বৌদ্ধ ভ্রাতৃত্ব সংঘের সহসভাপতি। সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়াও ১৯৯৭ সালে অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলো পুরস্কার, ২০০৭ সালে মহাত্মা গান্ধী শান্তি পদক লাভ করেন।
তার জন্ম ১৯৩৩ সালে, চট্টগ্রামে
সমকাল : আপনি জানেন, রাখাইনে কীভাবে রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা চলছে। শরণার্র্থীদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে...
সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি খুবই জটিল। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ। তার ওপর নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ। কিন্তু আমাদের পেছন ফিরে তাকাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও এভাবে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বিপদ মোকাবেলা করেছিলাম। একাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে, তার পরিবার বন্দি ছিল একটি বাড়িতে। সেখানে হাতেগোনা যে ক'জন খবরাখবর আদান-প্রদান করতে পারত, আমি তার একজন ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের এই মহাবিহারে নেতৃস্থানীয় অনেককে আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম। গোপন দুটি কক্ষে তারা থাকতেন। দুই-একজন ছাড়া বিহারেরও কেউ জানতেন না। বঙ্গবন্ধু আমার গুরুকে ও আমাকে ভালোবাসতেন। আমরা যখনই প্রয়োজন, তার কাছে গেছি। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের চরম বেদনাহত করেছিল। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তার সঙ্গে আমরা দেখা করেছি। তিনিও এখানে এসেছেন। সব সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি মনে করি, এখনকার সংকটের সময়ও জাতীয় ঐক্য জরুরি। সবাই মিলে এ সংকট উত্তরণ করতে হবে।
সমকাল :আমরা জানি, এ বছরের মার্চে আপনি মিয়ানমার গিয়েছিলেন। তখন দেশটির 'স্টেট কাউন্সেলর' অং সান সু চির সঙ্গেও আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে। এ সময় কি রোহিঙ্গা বা রাখাইন ইস্যুতে আপনাদের মধ্যে কোনো কথা হয়েছিল?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম মূলত আমার মাসি ও মেসোমশাইয়ের সমাধিস্থলে সম্মান জানাতে ও প্রার্থনা করতে। এ সময় সু চি আমাকে 'দান' দিতে এসেছিলেন। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, আপনার পিতার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমাদের এলাকায় তার সফরেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অকালে নিহত হওয়ার কারণে আর পারেননি। আপনার পিতার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল। তারাও মিয়ানমারেরই মানুষ। বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে তারা খুবই কষ্টের জীবনযাপন করছে। অত্যন্ত অবমাননাকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। আপনি আরাকানে তাদের জন্য একটি অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেন, যেখানে তারা শান্তিতে থাকতে পারবে। আমি বলেছিলাম, আপনাদের অনেক পর্বত জনবসতিহীন। এর একটা দিয়ে দিলেই বাংলাদেশে আটকে থাকা পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা থাকতে পারবে। আরাকানে হাজার বছর ধরে সবাই মিলে-মিশে থেকেছে। আপনি চাইলে এখনও সে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারেন।
সমকাল :এর উত্তরে তিনি কী বলেছিলেন?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :অন্যান্য বিষয়ে তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে এই বিষয়ে তিনি কেবল মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। কোনো জবাব দেননি বা কোনো মন্তব্য করেননি।
সমকাল :সু চির পিতার সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ কীভাবে?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :আমার গুরু বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খুবই পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার সঙ্গে জেনারেল অং সানের যোগাযোগ ছিল। তারা প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। ১৯৫২ সালে এই মহাবিহার প্রতিষ্ঠার পর অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে এসেছেন। ১৯৬০ সালে থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল ও রানী এসেছিলেন। আমাকে একবার চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন- ভিক্ষু আপনি, কী চান? তাকে বলেছিলাম- কিছুই চাই না। শুধু অতীশ দীপঙ্করের চিতাভস্ম পেলে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই। তিনি সেখানকার সন্তান। আমাদের এই মহাবিহার আচার্য অতীশ দীপঙ্করের সেই পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করছে। আমাদের আলোচনা শেষে আপনাকে নিয়ে যাব। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন- কী চান? আমি বলেছিলাম, ভারতে বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য একখণ্ড জমি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছিলেন। আমাদের এ অঞ্চল আসলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। তিনি অন্য ধর্মের, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় পিছপা হননি। বাংলাদেশেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব ধর্মের মানুষকে মাতৃ-মমতায় আগলে রেখেছেন। আমরা বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম পাশাপাশি বসবাস করে এসেছি। খ্রিস্টানরা পরে এসেছে এ অঞ্চলে; কিন্তু তারাও আমাদেরই মানুষ। একে অপরের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছি।
সমকাল :রাখাইনে যে সংকট দেখা দিয়েছে; এ ক্ষেত্রে কী করার আছে?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :সেখানে সহিংসতা দেখা দেওয়ামাত্র আমরা কিন্তু নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। ঈদের আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছি আমরা বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে। এই মহাবিহারে টিভি চ্যানেলগুলো এসেছে। আমরা বলেছি, রাখাইনে যা কিছু ঘটছে, খুবই দুঃখজনক। সেখানে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, অনুরোধ জানিয়েছি- দৃঢ়হস্তে সেখানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন। আমরা ২০ লাখ বৌদ্ধ যেভাবে বাংলাদেশে শান্তিতে বসবাস করছি, রাখাইনেও রোহিঙ্গারা যেন সেভাবে শান্তিপূর্ণ জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। আমাদের ধর্মের অন্যরা এসব দাবিতে মানববন্ধন করেছেন, মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমি নিজে অসুস্থ থাকায় কক্সবাজার যেতে পারিনি। কিন্তু আপনি দেখবেন, আমাদের বৌদ্ধ সমাজের মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়িয়েছে।
সমকাল :রাখাইনের এই সহিংসতা বাংলাদেশে কি কোনো অস্বস্তি তৈরি করছে?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। ধর্মীয়ভাবে আমাদের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সামাজিকভাবে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। পরস্পরের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। যেমন এই মহাবিহার থেকে ১০ বছর ধরে আমরা রোজাদারদের ইফতার করাই। আমাদের বিদ্যালয়ে সব ধর্মের মানুষ পড়াশোনা করতে পারে। ফ্রি পড়াশোনা। আমাদের এখান থেকে ১২ জন মুসলিম শিশু এখন এমএ পাস করেছে। আমরা বিহার থেকে সবার জন্য পানি ফ্রি করে দিয়েছি। আশপাশের যার প্রয়োজন নিয়ে যাবে। আমার সহকর্মীদের বলা আছে, আমি একজন গরিব ভিক্ষু, কিন্তু কেউ যেন আমাদের এখানে এসে ফিরে না যায়। সবার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব। বায়তুল মোকাররমের আগের খতিব, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার খুবই হৃদয়তা ছিল। আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতাম, আলোচনা করতাম। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের এই সম্প্রীতির ঐতিহ্য এত ঠুনকো নয় যে, কোনো একটি ঘটনায় ভেঙে পড়বে। তারপরও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অতীতে কিছু গোষ্ঠী এই সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা করেছে। তারা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নয়। ফলে সরকারকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
সমকাল :রাখাইনে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :এটা আসলে ধর্মীয় সমস্যা নয়, সামাজিক সংকট। রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুসলিম বেশি; কিন্তু হিন্দু ও বৌদ্ধও রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মুসলিম রয়েছে। কারণ যাই হোক, বাংলাদেশকে এই সংকট দেখতে হবে মানবিকভাবে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। আবার তারা যাতে নিজের দেশে ভালোভাবে ফেরত যেতে পারে, শান্তিতে বসবাস করতে পারে; সেই চেষ্টাও চালাতে হবে। আমি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে দু'হাত তুলে আবেদন জানাই- এদের ফিরিয়ে নিন। নিজের দেশে থাকতে দিন। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল, সেই সঙ্গে দুর্যোগপ্রবণ। আমরা চাইলেও আমাদের সামর্থ্য সীমিত। আমি চাই- বিশ্ববিবেক জাগ্রত হোক। মিয়ানমার ছাড়াও চীন, ভারত- সবাই রোহিঙ্গাদের সংকটকে মানবিক দিক থেকে দেখুক।
সমকাল :রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে, রাখাইনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠী ছাড়াও কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষুও তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয়। তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাধারণ রাখাইনদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা হচ্ছে অহিংসা; সকল জীবের প্রতি প্রেম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ। আমি বিশ্বাস করতে পারি না- কোনো ভিক্ষু কারও বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পারেন। যদি কেউ ধরে থাকে, তাহলে সে প্রকৃত ভিক্ষু নয়। আমি রাখাইনের ভিক্ষুদের প্রতি আবেদন জানাই- আপনারা বরং রোহিঙ্গাদের রক্ষায় এগিয়ে আসুন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের অভয় দিন, হামলাকারীদের ব্যাপারে সবাইকে সজাগ করুন। বলুন- এরা আসলে ধর্মের শত্রু, মানবতারও শত্রু।
সমকাল :তিব্বতের ধর্মীয় গুরু দালাই লামাও অং সান সু চির কাছে চিঠি লিখেছেন। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে গৌতম বুদ্ধের পথ অনুসরণ করতে বলেছেন। তার এ আহ্বান কি মিয়ানমার আমলে নেবে?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :আমি দালাই লামাকে সমর্থন করি। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ। সর্বশেষ ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়েছিল। তিনি মঞ্চে উঠেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পরিবেশে আমরা মতবিনিময় করেছি। তিনি সু চিরও ঘনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী। মিয়ানমারের উচিত তার আহ্বানে সাড়া দেওয়া।
সমকাল :বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি দল কি মিয়ানমার যেতে পারে সেখানকার সরকার ও ভিক্ষুদের বোঝানোর জন্য?
শুদ্ধানন্দ মহাথেরো :আমি তো মনে করি, যাওয়াই উচিত। বাংলাদেশের একটি বৌদ্ধ প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাওয়া উচিত। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টিও ভাবতে পারে। আমার নিজেরও যাওয়ার ইচ্ছা আছে, যদি সরকার প্রয়োজন মনে করে। আমি গেলে অং সান সু চির সঙ্গে অবশ্যই দেখা ও কথা হবে। তিনি এর আগেরবার এক লাখ মানুষ নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি তাকে বলব, আপনি মিয়ানমারের নেতা। মিয়ানমারের সব অধিবাসীর নেতা। বাংলাদেশের মানুষও আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি যখন কারাগারে ছিলেন, তখন আমরা বাংলাদেশ থেকে আপনার মুক্তি কামনা করেছি। আপনার মুক্তির দাবি করেছে সবাই। আপনি রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দূর করে দিন। সুত্র : সমকাল