প্রকাশিত: ২০/০৬/২০১৬ ৮:২৯ এএম

rohinga-refuge-of-bangladesh_9857জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ থেকে :

আজ ২০ জন বিশ্ব শরনার্থী দিবস। বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার নিবন্ধিত মিয়ানমার মুসলিম রোহিঙ্গা শরনার্থী। এ ছাড়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। জানা যায়, ১৯৯১-১৯৯২ সালে মিয়ানমার হতে আসা প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ মিয়ানমারে ফিরে গেলে বাংলাদেশে এখনও রয়ে যায় ত্রিশ হাজারেরও অধিক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা। এসব মিয়ানমার মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে থাকলেও এখানে বিভিন্ন ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে টেকনাফে লেদা, শামলাপুর ও উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় অনিবন্ধিত ক্যাম্প তৈরী করে বসবাস করছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এ ছাড়া কক্সবাজার, চট্টগ্রাম,বান্দবোন ,রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে প্রায় পাচঁ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। বালাদেশের শ্রম বাজার থেকে বিভিন্ন কাজের দখল দারিত্ব এখন রোহিঙ্গাদের হাতে। বন উঝাঁড় ও পাহাড়ে বসতি স্থাপন সহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডও ঘটিয়ে যাচ্ছে নাম পরিচয় হীন এসব রোহিঙ্গা। বাংলাদেশীদের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। বাল্য বিয়ে ও বহু বিয়ের প্রবনতা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিয়ানমার নাগরিক এসব রোহিঙ্গারা পরিচয় হীন ভাবে বসবাস করায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের অধিবাসীরা। সম্প্রতি নয়াপাড়া ক্যাম্পের আনসার ক্যাম্পের অস্ত্র ও গুলি লুট এবং আনসার কমান্ডার হত্যাকান্ডেও জড়িত এসব রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে কৌশলে ভোটার হওয়ার পাশাপাশি পাসর্পোট তৈরী করে বিদেশে বাংলাদেশী পরিচয়ে দেশের ভাবমুর্তি নষ্টের মূলে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্টি। নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোঃ আফজান বলেন, কিছু কিছু সন্ত্রাসীর কর্মকান্ডকে গোটা জনগোষ্ঠির উপর চাপিয়ে দেওয়া সঠিক হবে না। চিহ্নিত রোহিঙ্গা সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় সোচ্চার রয়েছি। প্রশাসনকে ক্যাম্প এলাকার শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছ্ ি।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি আব্দুল মজিদ জানান, এখানের বেশীর ভ্গা অপকর্ম সংগঠিত করে থাকে রোহিঙ্গারা। চোরাচালান, মানবপাচার ও মাদক বিশেষ করে ইয়াবা পাচারে বড় ভ’মিকা রাখছে রোহিঙ্গারা।

থমকে আছে শরনার্থী প্রত্যাবাসন

থমকে আছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ। ফলে বাংলাদেশে অবস্থান নেওয়া প্রায় ত্রিশ হাজারেরও অধিক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরনার্থীরা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। তারা নাগরিকত্ব হীন অবস্থায় বাংলাদেশের দুটি ক্যাম্পে অবস্থান করছে প্রায় ২৬ বৎসর যাবৎ। পাশাপাশি অন্যান্য সময়ে মিয়ানমার হতে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ভাগ্যে কি ঘটবে তার হিসেব মিলাতে পারছেনা কেউ। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত দু’লাখ ছয়ত্রিশ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী মিয়ানমারে ফিরে যায়। এরপর বন্ধ থাকে প্রত্যাবাসন কাজ। এ ফাকেঁ ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তৃতীয় দেশে পুর্নবাসিত করা হয়েছে ৯২৬ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীকে। এরমধ্যে কানাডায় ৩০৯ জন, যুক্তরাজ্যে ১৯০ জন, নিউজিল্যান্ডে ৫৬,যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ জন. নরওয়েতে৪ জন,আয়ারল্যান্ডে ৮২ জন, সুইডেনে ১৯ জন ও অষ্ট্রেলিয়ায় ২৪২ জন। বাংলাদেশে রয়ে যায় বাকী শরনার্থীরা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার নয়া পাড়া ও উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকায় দু’টি ক্যাম্পে বর্তমানে নিবন্ধিত শরনার্থীর সংখ্যা হচ্ছে ৩১ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে কুতুপালং এ ১৩ হাজার ৪৫ জন ও নয়াপাড়ায় ১৮ হাজার ৭১৪ জন। এদের ভাগ্যে কি ঘটে তা বলতে পারছে না কেউ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এসব রোহিঙ্গারা। এ প্রসংগে নয়াপাড়া ক্যাম্পের ব্যবস্থপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্ন শেষ হয়ে গেলেই দেশে চলে যাবো। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও জনগনের প্রতি কৃতজ্ঞ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা। তবে শরনার্থী জীবন ভাসমান জীবন, যাদের কি না ভবিষ্যৎ দেখা যায় না , এভাবে যেন কেউ বেচেঁ না থাকে তার জন্য আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন এ নেতা।

এ প্রসংগে আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মুখপাত্র আসিফ মুনীর জানান, দু দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতে পারে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে দিকে একটি কর্মকৌশন ঠিক করেছে। সরকার রোঙ্গিহা সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ্যমিয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। হয়তো সে অনুযায়ী এগোচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

জেলায় চলছে রোহিঙ্গা শুমারী

বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারি রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণে চলছে রোহিঙ্গা শুমারি। গত ২ জুন থেকে শুরু হওয়া এ শুমারি চলে ১৪ জুন পর্যন্ত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে খানা (বাড়ি) তালিকা করা হয়। এ তালিকার ভিত্তিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এ শুমারি করা হয়। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করে গেছেন আরাকানী রোহিঙ্গা শরনার্থী কল্যান পরিষদ। দেশের কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী জেলায় প্রাথমিকভাবে এ শুমারি শুরু করেছে পরিসংখ্যা ব্যুরো। এর মধ্যে কক্সবাজারে ৮৮৬টি দল শুমারির তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন। এরমধ্যে টেকনাফের ৩২৫ টি, উখিয়া উপজেলায় ২১৫টি, রামু উপজেলায় ৬৮টি, কক্সবাজার সদর উপজেলায় ১৯১টি, চকরিয়া উপজেলায় ৫২টি, পেকুয়া উপজেলায় ৪টি, মহেশখালী উপজেলায় ২৯টি ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ২টি দল তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে। জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে খানা তালিকা করা হয়। এ তালিকা অনুযায়ী দেশের ছয় জেলায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার খানায় রোহিঙ্গা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন ওই সব খানা বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ চলছে। বলা হয়ে থাকে, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। নিজ দেশ মিয়ানমারে যাদের নাগরিকত্ব নেই। অস্বীকৃতি, জাতিগত দাঙ্গা আর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার আড়াই থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এসব রোহিঙ্গাদের সঠিক পরিসংখ্যা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিসংখ্যা ব্যুরোর অধিনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তৈরি করা হয় খানা তালিকা। যে তালিকায় রোহিঙ্গা অবস্থানরত বাড়িগুলো শনাক্ত করা হয়। ওই শনাক্ত হওয়া বাড়িতে এখন তথ্য সংগ্রহের কাজও শেষ হয়েছে। রোহিঙ্গা শুমারি প্রকল্পের পরিসংখ্যা ব্যুরোর পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন জানান, শুমারির মাধ্যমে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে। শুমারিতে ছবিসহ প্রায় ৪৬ ধরনের তথ্য নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের ঠিকানা, সেখান থেকে আসার কারণ এবং বাংলাদেশে অবস্থানের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। যাদের নাম শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হবে, তাদের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র দেয়া হবে। যা দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।এই শুমারির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য ভা-ার তৈরি হবে বলে আশা করছেন তিনি। আরাকানী রোহিঙ্গা শরনার্থী কল্যান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ শাহ জানান, ভাসমান না থেকে একটি পরিচয়ে বসবাস ও দাবী আদায়ের জন্য শুমারি একটি বড় ধরনের ভ’মিকা রাখতে পারে।

জঙ্গি তৎপরতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের গহিন অরন্যে স্বশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠির অবস্থান রয়েছে এমন অভিযোগ পুরানো। বান্দরবানের লেম্বুছড়ি, জারাইল্লা ছড়ির গভীর জঙ্গলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারেটি অর্গানাইজেশন(আরএসও)’র স্বশস্ত্র ঘাটি কথা প্রায় সময় বলা হয়ে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে রয়েছে এ সংগঠনের শাখা। এরা রাজনৈতিক ভাবে মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য অর্থ ও সামরিক সাহায্য আদায়ে কাজ করে থাকে। তবে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধ মন্দির ও পল্লীতে হামলা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ,গত ১৩ মে ভোরে টেকনাফের নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের আনসার ব্যারাকের অস্ত্র ও আনসার পিসি হত্যায় আরএসও সহ রোহিঙ্গা সম্পৃক্ততার কথা প্রমাণিত সত্য। এ প্রসংগে টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন বলেন, ধৃত আসামী নুরুল আবছারের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে এসেছে আরএসও’র কর্মকান্ড ও রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে। সে তথ্যের সুত্র ধরে তদন্ত কাজ চলছে। টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংস্থার সভাপতি এম মোজাম্মেল হক কলেন, আরএসও’র কর্মকান্ড বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় অনেকটা প্রকাশ্য ছিলো। আমরা এদের বিরোদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছিলাম। বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করেছে। তিনি এ সব বিবেচনা করে দ্রুততম সময়ে শরনার্থী সমস্যার সমাধান হলে বাংলাদেশ বাচঁতো। বাচঁতো মানবতা। বলেও মন্তব্য করেন।

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু, দৈনিক উৎপাদন ৩০ মেগাওয়াট

কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল উপকূলে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছেছবি: প্রথম আলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং!

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে ‘টার্গেট কিলিং’। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ...

জান্নাতুলকে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করলেন কক্সবাজারের রেজা

রাজধানীর পান্থপথে আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ...