ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক উপকূলীয় নৌ বাণিজ্য অসফল হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক স্বার্থে বিকল্প নৌরুট নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাইছেন। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নৌরুট বিবেচনায় আনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এই উপকূলীয় নৌরুটটি অন্তত ভারতের চেয়ে বেশি লাভজনক প্রমাণিত হবে।
সূত্র মতে, অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের উপকূলীয় নৌ বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু হয়েছিল গত ২৩ মার্চ। কিন্তু আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যবধানে তা এখন প্রায় অকার্যকর। মার্চের শেষে শুরু হওয়ার পর জুলাই পর্যন্ত তিনমাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৮টি ভয়েজ করতে পেরেছিল জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নিপা পরিবহন। পরবর্তীতে এখন পর্যন্ত আর চালু হয়নি বাংলাদেশ-ভারত উপকূলীয় নৌ বাণিজ্য।
নিপা পরিবহনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের বিশাখাপত্তম বন্দরে যাওয়ার জন্য প্রথম দিনে আমরা খালি কনটেইনার পেতে সময় লেগেছিল তিনদিন। প্রথম উদ্বোধনী দিনে গেলেও পরবর্তীতে আরো ৭টি ভয়েজ করা হলেও আমরা শুধুমাত্র কলকাতা বন্দর পর্যন্ত গিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে আমাদের দেশে প্রচুর লৌহজাত সামগ্রী আমদানি করা হয়। কিন্তু সেগুলো জাহাজের অর্ধেক জায়গায় নিলেই জাহাজে আর মালামাল নেয়ার সক্ষমতা থাকে না এবং ব্যবসায়িকভাবে তা সফল হয় না। এছাড়া আমাদের দেশ থেকে কোনো রপ্তানি না যাওয়ায় মূলত খালি অবস্থায় ভারত যেতে হয়, তাই এই রুটটি লাভজনক নয়।’
বর্তমানে মিয়ানমারের সাথে উপকূলীয় নৌ বাণিজ্য চালুর কথা চলছে এবং আগামী বৃহস্পতিবার দুই দেশের সচিব পর্যায়ে একটি বৈঠকও রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সাথে আমাদের অনেক ট্রেড রয়েছে। তবে পূর্ব দিকের এই রুটটিকে ফলপ্রসূ করতে হলে মিয়ানমার হয়ে তা থাইল্যান্ডের রেনং বন্দর পর্যন্ত নিতে হবে। কারণ থাইল্যান্ড থেকে আমাদের দেশে প্রচুর পণ্য আমদানি হয় এবং থাইল্যান্ডে প্রচুর খালি কনটেইনারের প্রয়োজন রয়েছে। আর মধ্যখানে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন ও সিটওয়ে বন্দর থাকলে সেসব পণ্যেও আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন করা সহজ হবে।’
একই অভিমত প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি পিআইএল’র বাংলাদেশ শাখার মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জহির বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যে ২০ ফুটের কনটেইনার বেশি আসে এবং রপ্তানি হিসেবে ৪০ ফুটের কনটেইনার বেশি যায়। এখন মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাথে উপকূলীয় নৌবাণিজ্য চালু করা হলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সুবিধা পাবে। এই রুটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ২০ ফুটের খালি কনটেইনারগুলো মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের রেনং বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাবে, তাহলে আর সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে খালি কনটেইনার আনতে হবে না। এতে জনপ্রিয় হবে নৌ রুটটি।’
এদিকে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ছয় কোটি জনসংখ্যার মিয়ানমারে ওষুধ পণ্যের বাজার রয়েছে প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের। এছাড়া পোশাক শিল্প, সিমেন্ট, নির্মাণসামগ্রী ও বিবিধ সামগ্রীর বিশাল বাজার রয়েছে মিয়ানমারে। অপরদিকে মিয়ানমার থেকে প্রচুর কাঠ, মাছ, কৃষিপণ্য আমদানি হয়। দুই দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানির ফারাকও বেশি নয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি হলেও আমদানি হয়েছিল ৯২ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি হলেও আমদানি হয় ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। অপরদিকে ২০১৫-১৬ সালে ৩৮ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও আমদানি হয় ৩৮ দশমিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই হিসেবে দুই দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানির ভারসাম্য রয়েছে।
মিয়ানমারে গার্মেন্টস পণ্যের বাজার ভালো রয়েছে জানিয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমারে বিনিয়োগের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। আর গার্মেন্টস সেক্টরেরও চাহিদা রয়েছে। তাই মিয়ানমারের সাথে উপকূলীয় নৌ রুট চালু করা গেলে আমাদের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।’
চিটাগাং চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘মিয়ানমারের সাথে আমাদের ভাল বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। তা কাজে লাগাতে পারলে মিয়ানমারের সাথে উপকূলীয় নৌ রুট চালু করা যেতে পারে। তবে এই রুটের সাথে থাইল্যান্ডের রেনং বন্দর যুক্ত করা গেলে আরো ফলপ্রসূ হবে।’
থাইল্যান্ডের রেনং বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের উপকূলীয় নৌ রুট নিয়ে দ্বিপাক্ষিক কথা হয়েছিল চলতি বছরের মাঝামাঝিতে। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড উপকূলীয় নৌ চলাচল বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘থাইল্যান্ডও চেয়েছিল মিয়ানমারকে নিয়ে এই রুট চালু করতে। বর্তমানে তা আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।’
বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বারের সভাপতি নুরুল হক বলেন, ‘মিয়ানমারের সাথে উপকূলীয় নৌবাণিজ্য চালু করা গেলে অফিসিয়ালি বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশের যেমন সুযোগ বাড়বে তেমনিভাবে আমাদের বাজারও বড় হবে। একইসাথে যদি তা থাইল্যান্ড পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় তাহলে এই রুট আরো বেশি কার্যকর হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সাথে বর্তমানে ভারতের উপকূলীয় রুটে নৌ চলাচলের অনুমোদন রয়েছে। এই সুযোগ থাইল্যান্ড চেয়েছে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে।