বান্দরবানে গত চার দিনে ৬০টি গাছ কাটা হয়েছে। কাটা হবে মোট এক হাজারটি। মেহগনি, গর্জন, একাশিয়া প্রজাতির গাছগুলোর বয়স ২৫ থেকে ৬০ বছর। এই গাছ কাটায় বাধা দিচ্ছে না প্রশাসন বা বন বিভাগ।
গাছ কাটা হচ্ছে সদর উপজেলার রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা পর্যন্ত ৭.১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রামীণ সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নের নামে এগুলো কাটছেন স্থানীয় গাছ ব্যবসায়ী আমানউল্লাহ আমান।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার রেইচা ও গোয়ালিয়াখোলা এলাকায় সব ঋতুতে ফসল ফলে। সড়কের আশপাশের এলাকাটি কৃষিভূমি। এটি সদরের সবজি উৎপাদনের ‘রাজধানী’ নামে পরিচিত। এই রাস্তার দু’পাশে বেষ্টিত হাজারের অধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এগুলো বহু বছর ধরে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। সেই গাছ কাটায় স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন দেখা গেছে, রাস্তার দু’পাশ থেকে ইতোমধ্যে শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। অনেক গাছের ডালপালা ছেঁটে রাখা হয়েছে। অনেক গাছের গুঁড়ি এক্সক্যাভেটর দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে। পরে সেখানে মাটি ভরাট করা হয়েছে যেন গাছের চিহ্ন বোঝা না যায়।
এদিকে স্থানীয়দের দাবি, দুই বছর আগেও এই রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহ ছিল। এলাকায় সবুজ বেষ্টনী ছিল। বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া এমন গাছ হতে আরও ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তারা।
বান্দরবান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। বান্দরবান-কেরানীহাট প্রধান সড়ক থেকে রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা পর্যন্ত রাস্তাটি সম্প্রসারণ করা হবে। কাজটি চলমান।
গাছ কাটায় নিয়োজিত শ্রমিক নজরুল ও মোহাম্মদ রফিক জানান, গাছগুলো কাটার জন্য বলেছেন ব্যবসায়ী আমানউল্লাহ আমান। গত চার দিনে চার শ্রমিক মিলে ৫৫-৬০টি গাছ কাটতে পেরেছেন। রাস্তার দু’পাশের সব গাছ কাটা হবে।
তারা আরও জানান, দিনে গাছের ডালপালা কেটে রাখেন। রাতে একদল এসে গাছের গুঁড়ি থেকে কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যায়। আরেকদল পরের দিন এক্সক্যাভেটর দিয়ে গুঁড়িগুলো উপড়ে ফেলে মাটি দিয়ে ভরাট করে রেখে দেয়।
গাছগুলো কাটার জন্য নিলামের মাধ্যমে অনুমতি পেয়েছেন দাবি করে কর্তনকারী আমানউল্লাহ আমান বলেন, “এই রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য যখন বাজেট প্রণয়ন করা হয়, তখন বান্দরবান সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবুখয় মারমা। তাঁর নেতৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদ গাছগুলো কাটার জন্য নিলাম ডাকে। ২০১৮ সালের নিলামে ১০ লাখ টাকায় রাস্তার দু’পাশের মোট এক হাজার গাছ কাটার জন্য অনুমতি পেয়েছি।”
এ বিষয়ে বান্দরবান সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাবুখয় মারমা জানান, এলজিইডি থেকে রেইচা-গোয়ালিয়াখোলার রাস্তা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ আসে। উপজেলা প্রশাসন ও এলজিইডি থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর রেইচা-গোয়ালিয়া খোলার রাস্তার পাশের গাছ কাটার জন্য নিলাম ডাকা হয়। আমানউল্লাহ ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে নিলামে বিজয়ী হন। গাছ কাটার আগে তিনি ৫ লাখ টাকা নগদ দেন এবং বাকি টাকা পরে দেবেন বলে গাছ কাটা শুরু করেন। তখন গাছ কাটতে উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ বাধা দেয়। উপজেলা প্রশাসন, এলজিইডি, ইউনিয়ন পরিষদ ও বন বিভাগকে বিবাদী করে আদালতে মামলা করেন আমানউল্লাহ।
ব্যবসায়ী আমানউল্লাহ বলেছেন, ‘আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন আদালত।’ তবে এ তথ্য যাচাই করতে পারেনি সমকাল।
বান্দরবান সদর বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ টিপু বলেন, ‘রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা রাস্তাটি স্থানীয় প্রশাসনের অধীন। সেখানে বন বিভাগ অংশীজন নয়। রাস্তার দু’পাশে গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা চলমান। তা ছাড়া ১৯৭০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রোড পারমিট আইন অনুযায়ী পাহাড়ে যে কোনো ধরনের গাছ-বাঁশ পরিবহনের জন্য বন বিভাগের অনুমতিপত্র লাগে। এটা ছাড়া কোনো গাছ পরিবহন করা যাবে না। তাই কেউ অনুমতি ছাড়া গাছ পরিবহন করলে ব্যবস্থা নেবে বন বিভাগ।’
এলজিইডি বান্দরবানের সিনিয়র প্রকৌশলী পারভেজ সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবে না এলজিইডি। আমরা কাউকে গাছ কাটা কিংবা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য সুপারিশ বা অনুমতি দিতে পারি না।’
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ সংগঠনের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি জোয়াম লিয়ান আমলাই বলেন, “প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হচ্ছে। বন রক্ষায় অনেক ফোরামে কথা বলেছি। সরকারিভাবে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। যেভাবে বন ধ্বংস করা হচ্ছে, একদিন বিরাট প্রভাব ফেলবে বান্দরবানসহ পুরো দেশের ওপর। গোয়ালিয়াখোলায় সড়কের দু’পাশে যে গাছ কাটা হচ্ছে, তা পরিবেশের জন্য খুবই খারাপ হবে। একপাশে গাছ রেখেও সড়ক প্রশস্ত করা যেতে পারে।”
জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত ইউএনও) মো. ফয়সল উদ্দিন বলেন, ‘রেইচা-গোয়ালিয়াখোলা সড়ক প্রশস্তে গাছ কাটার বিষয়ে কোনো কিছু জানা নেই। বিষয়টি জেনে আপনাকে জানাতে পারব। সমকাল