অনেক কথা চালাচালি হলো। পেপার পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম আর মতামত কলামে নানা রকম মত পাল্টা মত দেয়া নেয়া হলো। এ পক্ষ ও পক্ষ নানা রকম বক্তব্য দিল, মন্তব্য করলো। কিন্তু এতো কিছুর পরও সত্যি বলতে কি পুরো ঘটনাটা নিয়ে ধোঁয়াশাটা ঠিক কাটলো না। আমার ধারণা আমার মতোই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই এ ব্যাপারে যথেষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে।
বলছিলাম পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা নিয়ে। এ বছরের অন্যতম চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনাটা এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত এবং যথেষ্ট রহস্যময়। কিন্তু তারচেয়েও বিস্ময়কর পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে নিয়ে পুলিশ বাহিনী যা করেছে এবং করছে। যেভাবে পুরো বিষয়টাকে নিয়ে লেজেগোবরে মাখামাখি করা হলো তাতে করে পুলিশ বাহিনী এবং সরকার দুই পক্ষই যথেষ্ট পরিমাণে অদক্ষতা এবং ছেলেমানুষির পরিচয় দিয়েছে।
তাই পুরো বিষয়টা নিয়ে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা কতক প্রশ্ন। আমি নাদান মানুষ, বহু মাথা ঘামিয়েও তেমন কোনো জবাব খুঁজে পাইনি। তাই প্রশ্নগুলো সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে বসলাম। যদি উত্তর মেলে, সেই আশায়।
প্রথম প্রশ্ন হলো, বাবুল আক্তার কি আটক হয়েছিলেন নাকি হননি? স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় জেরে এক পর্যায়ে তাকে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গণমাধ্যমে বিষয়টি চাউড় হলে, প্রথমে বলা হলো বাবুল আক্তারকে আটক করা হয়নি, জিজ্ঞাসাবাদে সহযোগিতার জন্য তলব করা হয়েছে। আর এখন পুরোপুরি সুর পাল্টে বলা হচ্ছে তাকে তখন আটকই করা হয়েছিল এবং সে সময়ই বাবুল আক্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে পুলিশ। যে আটকের নাটককে কেন্দ্র করে বাবুল আক্তারকে পদত্যাগ করতে হলো সেটা নিয়ে অন্যরকম একটা ব্যাখা দিয়েছিল পুলিশ এবং বাবুল আক্তার উভয় পক্ষই। বাবুল আক্তার যদি আটক হয়েই থাকেন, সেটাকে পুলিশের লুকোতে হয়েছিল কেন? কেন পুলিশ সত্যিটা তখন বলেনি, স্বীকার করেনি? কেন সেসময় পুলিশ তালকে তিল করলো?
দ্বিতীয় প্রশ্ন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা, স্ত্রী হত্যার সঙ্গে কি বাবুল আক্তার আদৌ জড়িত? ঘটনার পরপর গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনতা, সাংবাদিক এবং পুলিশ, সবার তরফ থেকেই এসপি বাবুল আক্তারকে তুলে ধরা হয় একজন নায়কোচিত পুরুষের রূপে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই লড়তে গিয়ে তিনি কী করে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছেন সেটা নিয়েও বলা হলো নানা বীরত্বগাঁথা। কিন্তু এরপর শোনা গেল স্ত্রীর হত্যায় বাবুল আক্তারের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদি তিনি জড়িত হয়েই থাকেন তাহলে চাকরি যাওয়াটা কী করে সে অপরাধের শাস্তি হয়? মানুষ হত্যার শাস্তি চাকরি চলে যাওয়া এটা যেন কোথায় লেখা আছে?
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তাহলে কি এখন থেকে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা চাকরি ছাড়ার নিয়ত নিয়ে তাদের বউ খুন করতে পারবে? কেননা পুলিশ বিভাগ যেভাবে বিষয়টিকে জনতার চোখের আড়ালে রেখে, অনেকটা গ্রামের শালিসির কায়দায় মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে সেটা খুবই দৃষ্টিকটূ এবং বিপদজনক। পুলিশ বিভাগ একইসঙ্গে আইনের রক্ষক, বিচারক এবং শাস্তি নির্ধারণ করছে- সেটা কোনো স্বচ্ছ বা ন্যায়ানুগ প্রক্রিয়া না। বাংলাদেশে আইন আছে, আদালত আছে। অপরাধ সে যেই করুক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কিন্তু সে আদৌ অপরাধী কি না, বা হলে তার অপরাধের শাস্তি কী হবে-সেই বিচার করবে আদালত, পুলিশ বাহিনী না। এখন পুলিশ যদি তাদের বাহিনীর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের অজুহাত দেখিয়ে এ রকম একটা চাঞ্চল্যকর হত্যার এ রকম একটা মীমাংসা ঘটিয়েই ফেলে তাহলে কি এ প্রশ্ন করাটা খুব অবান্তর হবে যে, ‘লাপরোয়া, চাকরি ছেড়ে দেবো’ এ রকম একটি চিন্তা মাথায় নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের স্ত্রীদের হত্যা করতে পারবে?
উত্তর হ্যাঁ হলেতো খুবই বিপদ!
লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ
dhakatimes24