'সৈন্যরা এসে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি করছে। যদি সন্দেহ হয় তাদের কেউ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাথে জড়িত - তাহলে সে বাড়ি পুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করছে না সৈন্যরা। বাড়ি থেকে কাউকে বের হতে দেখলেই গুলি চলে। সৈন্যরা শুধু বাড়ি পুড়িয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেনা। বাড়ি পুড়িয়ে দেবার পর তাদের খোলা আকাশে তাদের বসিয়ে থাকতে বাধ্য করছে।'
গত এক সপ্তাহ ধরে বার্মার রাখাইন রাজ্যে যে সংঘাত চলছে, সেটিকে এভাবেই বর্ণনা করছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা। তাদের সাথে কথা বলতে আমি গিয়েছিলাম টেকনাফের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায়।
বাংলাদেশের ভেতরে অবৈধভাবে যেসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আছে তাদের অনেকের সাথেই সীমান্তের অপর পাড়ে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ আছে।
বাংলাদেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বার্মার সীমান্তের ভেতরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করে।
টেলিফোনের মাধ্যমে এপারের রোহিঙ্গারা খবর পাচ্ছেন যে বার্মায় নিরাপত্তা বাহিনী সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে..
বার্মার রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গা মুসলমান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সহ অন্তত ৪০ জন নিহত হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছেই যেখানে সহিংসতা হচ্ছে, সে জায়গাটিতে বার্মার সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী।
খবর পাওয়া যাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ব্যাপক নির্যাতন ও ধরপাকড়ের চলছে।
সংঘাতের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বার্মার সীমান্ত রক্ষীদের কয়েকটি ঘাটিতে হামালার পর। তাতে নয়জন রক্ষী নিহত হয়।
বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহ করছে সে হামলাগুলোর জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানরা দায়ী। তারপর থেকেই শুরু হয় চিরুনি অভিযান।
বাংলাদেশে বার্মা সীমান্তের কাছে বাসিন্দা হারুন শিকদার বলছিলেন, সীমান্তের ওপারে হেলিকপ্টার ওঠানামা দেখে তারা ধারনা করছেন বার্মার নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।
তিনি বলেন বার্মায় সংঘাতের কারণে নাফ নদীতে বাংলাদেশী জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ গেছে।
টেকনাফের উলুবুনিয়া এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা ওসমান গনি জানালেন তার ভাই বার্মায় বসবাস করছে। টেলিফোনে ভাইয়ের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছিল।
তিনি জানালেন, সৈন্যরা এসে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন তিনি বাংলাদেশ সীমানার কাছেই জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন। বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করছে।
দোভাষীর সাহায্যে ওসমান গনি বলেন, "সৈন্যরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের টার্গেট করেছে। নাসাকা (বার্মার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাক্তন নাম) এসে বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। দুই দিনে একশ'র মতো ঘর পুড়িয়েছে।"
উলুবুনিয়া এলাকায় বসবাসরত আরেকজন রোহিঙ্গা জানালেন গত শুক্রবার তার ভাইয়ের সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে।
তার ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারছেন যে সংঘাত শুরুর পর থেকে সৈন্যরা তিনটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। এসব গ্রামে মূলত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাস।
বার্মা থেকে অনেকেই সীমান্তে বৈধ অনুমতি নিয়ে চিকিৎসা এবং অন্যান্য কাজের জন্য বাংলাদেশে আসে। কিন্তু সম্প্রতি সহিংসতা শুরুর পর সেখান থেকে আসা যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী বলছে তাদের উপর আক্রমণের জন্য রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন দায়ী।
এ সংগঠনটি বাংলাদেশের ভেতর থেকে তৎপরতা চালায় বলে বার্মার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করছে।
গত বছর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বার্মার আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সীমান্তে জোরালো অভিযান চালিয়েছিল।
টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল-জাহিদ বলছেন, বার্মায় যেদিন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর উপর হামলা হয়েছে সেদিন থেকেই তারা সীমান্তে টহল জোরদার করেছেন।
মি: জাহিদ বলেন, "আমরা ধারণা করেছিলাম যে এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সন্ত্রাসীরা নিরাপদ একটা আশ্রয়ের যাওয়ার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে হয়তো বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তারা লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতে পারে। এটা আমরা নিজেরাই ধারণা করেছিলাম। সে অনুযায়ী আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা গ্রহণ করি।"
পরবর্তীতে বার্মার কাছ থেকেও এ ধরনের অনুরোধ আসে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বার্মায় যখনই কোন সহিংসতা হয় তখন সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে ঢোকার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক মি: জাহিদ বলছেন বার্মায় সংঘাত কোন প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি। সেখানে শুরু হবার পর কেউ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেনি।
ধারনা করা হচ্ছে, বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী চাইছে না সেখান থেকে কেউ অভিযান এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সৌজন্যে বিবিসি বাংলা