ড. মাহফুজ পারভেজ, অতিথি লেখক::
অতি দ্রুতই আমূল বদলে যাবে কক্সবাজারের সামগ্রিক নগর বিন্যাস ও পরিকাঠামো। আন্তর্জাতিক ¯্রােতের সঙ্গে মিলেমিশে জন্ম নেবে এক আলোকিত-উন্নত সৈকত জনপদ। বাস্তবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বহু-কাক্ষিত ‘স্বপ্নের কক্সবাজার’। আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে বললেন সাদ আলাউল হক, একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার স্থানীয় কর্মকর্তা তিনি। রাত তখন প্রায় ১টা। ক্যালেন্ডারে শুক্রবারের শুরু হয়ে গেছে। আলাউল তখনো ব্যস্ত। কক্সবাজার বিমান বন্দর কাল থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে। তার কাজের চাপ বাড়ছে। হেড অফিস থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সবাই উন্মুখ কক্সবাজারের অনাগত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর তাড়নায়।
কক্সবাজারের জন্য প্রধানমন্ত্রী ১৬ টি উন্নয়ন প্রকল্পের বিশাল প্যাকেজ নিয়ে আগামীকাল শনিবার আসছেন। [প্রকল্প নিয়ে আগের নিউজের লিঙ্ক] পুরো কক্সবাজার জুড়ে এ নিয়ে শিহরণ। চাঞ্চল্য সর্বক্ষেত্রে। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও জোরদার হয়েছে। হোটেলগুলোতে সরকারের নানা সংস্থার লোকজনের ভিড়। পর্যটন মৌসুম নয়, তবুও প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে জমজমাট কক্সবাজার। শনিবার দুই লাখ মানুষের সমাবেশ করার জন্য তৎপর আওয়ামী লীগ। সৈকত সংলগ্ন শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এজন্য সেজেছে বর্ণিত সাজে।
যতবার কক্সবাজার এসেছি, মাঝরাতে সৈকতে যাওয়ার কথা কখনো ভাবি নি। হোটেল ম্যানেজার বললেন, যেতে পারেন স্যার। কোনো অসুবিধা নেই। টুরিস্ট পুলিশ আছে। চুরি-ছিনতাই আজকাল হয় না। বিচ-ঘেঁষা হোটেল থেকে কয়েক পা এগিয়েই নিশুতি রাতের সৈকত। চারদিকে স্তব্ধ সমুদ্রের মৌনতা। বাতাসে ঝাউ গাছের পাতাদের মৃদ্যু স্পন্দন। আদিঅন্তহীন জমাট অন্ধকার বুকে নিয়ে সাগরের কালো চাদর। সেখানে মাঝে মাঝে মিটমিট করে জ¦লছে ফসফরাসের দ্যুতিময় আলো। কক্সবাজারের ভবিষ্যতের ললাটে যেন রূপালি সৌভাগ্য রেখার নির্মাণ চলছে।
কয়েক জন প্রহরী ছাড়া বিশেষ কাউকে দেখা গেল না রাত্রির সৈকতে। ভোরের আগেই সে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেল। স্বাস্থ্য উদ্ধারে মনোযোগী মানুষের কোলাহল বাড়ল সূর্য ওঠার আগেই। নারী, পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোরসহ ধীরে ধীরে মানবমেলায় মুখরিত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। নতুন সকালের চিরায়ত প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনে আগত মানুষজন জীবনকে ইতিবাচকভাবে উপভোগ করার প্রত্যয়ে উজ্জ্বল হলো।
সমুদ্র ভ্রমণের আড্ডা, বিনোদনের মধ্যেও প্রাধান্য পেল প্রধানমন্ত্রীর আগমন আর কক্সবাজার উন্নয়ন প্যাকেজ প্রসঙ্গ। ‘কক্সবাজারের সঠিক উন্নতি সম্পন্ন করা হলে এখানে আরেকটি সিঙ্গাপুর হবে।’ সদ্য জাপান প্রত্যাগত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আক্কাস আহমদ পূর্ব এশিয়ার প্রায়-সবগুলো দেশই চষে বেড়িয়েছেন। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন, বিশ^ায়ন ও আঞ্চলিক সংযোগ প্রচেষ্টায় কক্সবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে এই শহর। কক্সকাজারের উন্নয়ন সমগ্র বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তড়িৎ বেগে এগিয়ে নেবে।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ হোসাইন বিশ^াস করেন, সামনের দিনগুলোতে কক্সবাজারের দিগন্ত প্রসারিত হবে। মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে কক্সবাজারের পরিধি টেকনাফ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। পর্যটন, ফুড, হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিজ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। বিস্তৃত উন্নয়ন এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি আস্থাশীল।
তবে আশঙ্কার কথাও শোনা গেল। অধ্যাপক একেএম নূরুল বশর ভূইয়া সুজন উখিয়া উপজেলার বাসিন্দা হলেও কক্সবাজার-চট্টগ্রামের সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জাতীয় উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সব কিছুই নষ্ট হয়ে যেতে পারে আইন-শৃঙ্খলা ও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা না হলে। বিশেষত টেকনাফ, উখিয়ায় রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থানকে অপব্যবহার করে ইয়াবা, মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানের যে সি-িকেট গড়ে তুলেছে কতিপয় চিহ্নিত গডফাদার, সেটাই এ অঞ্চলের অগ্রগতির অন্তরায়। এই অপশক্তি সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে এবং যুব সমাজকে বিনষ্ট করছে। তদুপরি স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ইস্যুগুলো সমাধান করার জন্য তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামগ্রিক উন্নয়ন প্যাকেজ উন্নয়নমুখী স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমেই সফল হতে পারবে। মাদকচক্র ও মাফিয়ারা সেটা পারবে না।
ততক্ষণে সৈকতে সকালের তাজা রোদ ঝলমল করে ওঠেছে। আশা ও শঙ্কার কিছু মেঘ ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে। সমগ্র কক্সবাজারবাসীর মতো পুরো বাংলাদেশের মানুষ কামনা করছে উন্নয়নের পথযাত্রায় সকল আশঙ্কার চির-অবসান। প্রত্যাশা করছে, একবিংশ শতাব্দীর বিশ^ায়নের দ্রুতলয় পৃথিবীতে যোগ্যতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে কক্সবাজার হোক উন্নয়নের দিক-নিদের্শক বাতিঘর।