আবু তাহের, সমকাল::
নিবন্ধন সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের দেওয়া স্মার্টকার্ডের নাগরিক পরিচিতি কলামে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ লেখা নিয়ে আপত্তি তুলেছে মিয়ানমার। এ ক্ষেত্রে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও তারা মানতে নারাজ।
অন্যদিকে রোহিঙ্গারা দাবি করেছে, নাগরিক পরিচিতির অংশে ‘রোহিঙ্গা’ লিখতে হবে। এ দাবিতে গত মাসের শেষদিকে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে তারা ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। রোহিঙ্গা লেখা না হলে তারা নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নেবে না বলেও ঘোষণা দেয়। ফলে নাগরিক পরিচিতি নিয়ে নতুন এ জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন কার্যক্রম।
সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ৩ মাসে মাত্র ১৩ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করা গেছে। এখন কার্যত বন্ধ এ নিবন্ধন কার্যক্রম। তিনি জানান, পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন না হলে কোনোভাবেই তাদের নিজ দেশে ফেরানো সম্ভব হবে না।
মিয়ানমারের রাখাইনে গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলার জেরে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে ভয়াবহ অভিযান চালানো শুরু করে সেনাবাহিনী। চলে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। তারা আশ্রয় নেয় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক তালিকা তৈরি করে শুরু করা হয় ত্রাণ কার্যক্রম। এর পর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় বায়োমেট্রিক নিবন্ধন। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ কার্যক্রমে এ পর্যন্ত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ কার্ড। কিন্তু এসব এখন কোনো কাজে আসছে না।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রত্যাবাসন, ত্রাণ কার্যক্রম এবং অন্যান্য কাজের সুবিধার্থে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের পুনঃনিবন্ধন। গত জুলাই থেকে শুরু হয়েছে তৃতীয় দফায় এ নিবন্ধন। রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক এ নিবন্ধন কার্যক্রমে সহযোগিতা দিচ্ছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। মাঠ পর্যায়ে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন করে শুরু হওয়া পরিবারভিত্তিক এ নিবন্ধন কার্যক্রমে রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই সহযোগিতা করছে না।
বায়োমেট্রিক নিবন্ধন, বিপুল অর্থ জলে :রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। তবে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করে রোহিঙ্গাদের এ নিবন্ধন কোনো কাজে আসছে না। তারা বলেছেন, এ নিবন্ধন তালিকা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটি ত্রাণ বিতরণেও কাজে আসছে না। বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভুক্তি ও পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকাতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কার্যকর হবে। বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। এখন পর্যন্ত এ ব্যবস্থাও কার্যকর হয়নি। ফলে বহুসংখ্যক রোহিঙ্গা বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোটার তালিকাভুক্ত হচ্ছে এবং কৌশলে পেয়ে যাচ্ছে পাসপোর্ট।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ যারা কেন্দ্রে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে, তাদের ছবি ও আঙুলের চাপ নিয়ে নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে একটি কার্ড দেওয়া হয়েছে। ওই নিবন্ধন থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো তালিকা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, পরিবারভিত্তিক তালিকা না হলে প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে ফেরত পাঠাতে হবে। সেভাবেই নির্ভুল তালিকা তৈরি করে মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এ ধরনের তালিকা তৈরির জন্যই আবার পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন প্রয়োজন।
কক্সবাজারে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন করার জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে শুরুতেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি নমুনা ফরমও দেওয়া হয়েছিল। নিবন্ধন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু তাদের এ প্রস্তাবে প্রথমে সম্মতি পাওয়া যায়নি। পরে এ কাজের জন্য সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া হয়।
নতুন নিবন্ধন নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ও নানা শর্ত :রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় নতুন নিবন্ধন শুরু হয়। এতে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারপ্রধানের স্থানীয় ও অফিসিয়াল নাম, মিয়ানমারে তাদের গ্রামের স্থানীয় ও অফিসিয়াল নাম, পেশা, টাউনশিপের নাম, নাগরিক পরিচিতি, পারিবারিক ছবি ও বাংলাদেশে প্রবেশের তারিখ উল্লেখ রয়েছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন নিবন্ধনের পর যে কার্ড দেওয়া হচ্ছে, তাতে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা শব্দও তারা মানতে নারাজ। পরিবারভিত্তিক এ নিবন্ধনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে নতুন প্রস্তাব। এ ব্যাপারে নতুন একটি নমুনা ফরমও সরবরাহ করেছে তারা।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা জানান, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে প্রথমে একটি ফরম হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ফরমটি ছিল অনেক জটিল। এ নিয়মে তালিকা তৈরি করা ছিল কঠিন কাজ। এ বিষয়ে মিয়ানমারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাদের পক্ষ থেকে নতুন আরেকটি নমুনা ফরম দেওয়া হয়। ‘ভেরিফিকেশন ফরম ফর রেসিডেন্ট অব মিয়ানমার’ শিরোনামে এ ফরমে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গা পরিবারের গ্রুপ ছবি এবং পরিবারপ্রধানের পাসপোর্ট সাইজ ছবি সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। ফরমে রোহিঙ্গা পরিবারের অন্য যেসব তথ্য থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- পরিবারপ্রধানের নাম, পেশা, জন্ম তারিখ, জেন্ডার, জন্মস্থান, মিয়ানমারে পূর্ণ ঠিকানা, শনাক্তকরণ চিহ্ন, মা-বাবার নাম ও তাদের ঠিকানা, স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারের সবার নাম এবং তাদের ঠিকানা। নমুনা ফরমে রোহিঙ্গাদের স্বাক্ষর, দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ এবং বাংলাদেশে কোন ক্যাম্পে অবস্থান করছে, তা উল্লেখ থাকার প্রস্তাব রয়েছে।
এ বিষয়ে শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, মিয়ানমারের প্রস্তাব অনুসরণ করেই রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এ ব্যাপারে ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তবে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ লিপিবদ্ধ করা নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি রয়েছে বলে তিনি জানান।
শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার আরও বলেন, নতুন নিবন্ধনে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি লিপিবদ্ধ করার জন্য এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দাবি জানিয়েছে। এ নিয়ে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন :রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যৌথ একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমার তৈরি করছে নানা জটিলতা। ফলে চুক্তির শর্তমতে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। গত ২৩ নভেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মিয়ানমার সম্মত হয়েছিল- দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করবে। প্রথমে যাবে গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে ১ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত যারা এসেছে। তাদের প্রত্যাবাসন শেষ হলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গত অক্টোবর থেকে যারা এসেছে তাদেরকে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সমঝোতাপত্রেও একই শর্ত রয়েছে। সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পরও নানা অযৌক্তিক শর্ত জুড়ে দিচ্ছে মিয়ানমার। অন্যদিকে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে বাংলাদেশের অসম্মতির কারণে’ বলে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। জানা যায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত ৩০ সদস্যের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির তৃতীয় সভার তারিখও নির্ধারিত হয়নি। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ কমিটির সভা আয়োজনে সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না।
পাঠকের মতামত