দেশে বিদ্যুতের রেকর্ড ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা ছিল গতকাল রবিবার। উৎপাদনে রেকর্ড করলেও এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। গতকাল সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয়েছে ১৪ হাজার ৯৯৯ মেগাওয়াট। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড করেছিল বাংলাদেশ—১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট।
এই অবস্থায় সারা দেশে চলা দাবদাহের মধ্যে গতকাল এক হাজার এক মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। তবে রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিং কম হলেও গ্রামাঞ্চলে ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হয়েছে। বিপিডিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। আবহাওয়া অফিস বলছে, এই অবস্থা চলবে আরো কয়েক দিন। ফলে উৎপাদন না বাড়লে সমান তালে চলবে লোডশেডিংও। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করতে চেষ্টা করছে বিপিডিবি।
বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে দিনে চার থেকে আট ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে। ফলে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অফিস-আদালতে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়েছে। গরম সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বাড়িয়েছে রোজাদারদের। কষ্ট পেয়েছে শিশু ও বয়স্করা।
জানতে চাইলে বিপিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ পরিদপ্তর) মো. শামীম হাসান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তীব্র দাবদাহের কারণে মানুষ এখন এসির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে, যার কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন আরো বাড়িয়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটে নেওয়ার জন্য বিপিডিবি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ডিপিডিসি)—এই দুটি প্রতিষ্ঠান। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাওসার আমীর আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অতিরিক্ত চাহিদার কারণে আমাদের বিতরণ এলাকায় দিনের বেলা এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় চাহিদা অনুযায়ী শতভাগ সরবরাহ করা গেছে। আজ (গতকাল) আমাদের বিতরণ এলাকায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল এক হাজার ২৯১ মেগাওয়াট। এযাবৎকালে এটিই সর্বোচ্চ চাহিদা। এর আগে গত বছর সর্বোচ্চ চাহিদা হয়েছিল এক হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট।’
টঙ্গী-উত্তরা, বনানী-মহাখালী, গুলশান-বাড্ডা থেকে মিরপুর-পল্লবীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকা ডেসকোর অধীন। ডিপিডিসির অধীনে আছে ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার, পুরান ঢাকা ও মতিঝিল হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমাদের বিতরণ এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ এক হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াটের চাহিদা ছিল। এর আগে কখনো এত চাহিদা হয়নি। তার পরও আমাদের সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে না। তবে পাওয়ার গ্রিড কম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি) কয়েকটি এলাকায় ত্রুটিপূর্ণ লাইনের কাজ করছে, সেসব এলাকায় এক-দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে।’
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এলাকায় লোডশেডিং বেশি : দেশের বৃহত্তর বিতরণ কম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) বিতরণ এলাকায় সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছে। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে আরইবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সেই চাহিদা অনুযায়ী আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। যার কারণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’
কুড়িগ্রাম : প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে কুড়িগ্রামে ইফতার, সাহরি ও তারাবি নামাজের সময়ও বিদ্যুৎ থাকছে না। ঈদের কেনাকাটার এই শেষ সময়ে বিদ্যুৎ বিপাকে ফেলেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এই এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকায় নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেছে। ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম শহরের খলিলগঞ্জ বাজারের টিভি টেকনিশিয়ান এনামুল হক বাবু বলেন, ইলেকট্রনিকস সার্ভিসিংকাজ বিদ্যুিনর্ভর; কিন্তু এক-দুই ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ চলে যায়। দীর্ঘ সময় লোডশেডিং থাকে। ফলে কাজকর্ম করা যাচ্ছে না।
ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম): ভূরুঙ্গামারীতে বিদ্যুতের অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে ইরি-বোরো চাষের শেষ সময়ে এসে জমিতে পানি (সেচ) দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। পল্লী বিদ্যুতের ভূরুঙ্গামারী জোনাল অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় দৈনিক (দিবা) বিদ্যুতের চাহিদা ১৯ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র আট মেগাওয়াট। অন্যদিকে দৈনিক (নৈশ) চাহিদা ২২ মেগাওয়াটের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৯ মেগাওয়াট।
কেশবপুর (যশোর) : যশোরের কেশবপুরে আট থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। গরমে কাতর হয়ে গেছে মানুষ। বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলার পাইকেরছড়া গ্রামের কৃষক আবু সালেহ বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ ধান চাষ করেছি। পানির অভাবে ধানে নেক ব্লাস্ট ছত্রাক আক্রান্ত হয়েছে।’
পটিয়া (চট্টগ্রাম) : তীব্র গরম আর দিনে-রাতে আট থেকে ১০ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ার মানুষের জনজীবন। প্রচণ্ড গরমেও বিদ্যুৎ না থাকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ঈদের পর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়ালেখা নিয়ে বিপাকে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পটিয়া বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘পটিয়ায় দিনের বেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০-১১ মেগাওয়াট। আমরা পাচ্ছি পাঁচ-ছয় মেগাওয়াট। সন্ধ্যার পর চাহিদা থাকে ১৩ মেগাওয়াট; কিন্তু আমরা পাচ্ছি ছয়-সাত মেগাওয়াট। যার কারণে বেশির ভাগ সময় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।’
দুর্গাপুর (রাজশাহী) : দুর্গাপুরে এখন দিন-রাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র আট ঘণ্টারও কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। লোডশেডিংয়ে চার্জার ব্যাটারিচালিত ভ্যান ও অটোচালকরা পড়েছেন আরো বেশি ভোগান্তিতে। রাতের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় গাড়িতে চার্জ দিতে না পেরে রাস্তায় গাড়ি নামাতে পারছেন না তাঁরা। এ ছাড়া বিদ্যুতের সমস্যার কারণে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসেও ফটোকপি, প্রিন্ট করাসহ প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছে না।
উপজেলার উজানখলসী গ্রামের শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘বাড়িতে বৃদ্ধা বাবা ও এক শিশুসন্তান রয়েছে। রাতের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
রাজবাড়ী : গত শনিবার দিন থেকে কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। এমনকি ভোররাতে সাহরির সময়ও বিদ্যুিবহীন ছিল রাজবাড়ীর শহরবাসী। এর ওপর প্রচণ্ড গরম। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারের সদস্যরা।
ওজোপাডিকো রাজবাড়ীর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুনুর রশিদ বলেন, জেলার চাহিদা ৭০ মেগাওয়াট। সরবরাহ আছে ৫০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ২০ মেগাওয়াট। তাই লোডশেডিং করতে হচ্ছে।