আজকে খুব খুশি লাগছে। কেন, জানাই। কিছু ঘাস লাগিয়েছি। সামান্য কিছু। কিন্তু আসলে সামান্য না। এই তৃণ যে জীবনবৃক্ষ!
কুতুপালং এসেছিলাম গত মাসে। এসে দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম কিভাবে আমরা মাত্র দুই মাসে এই দশ লক্ষাধিক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার জীবন ধারণের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু তার কয়েকদিন পরেই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। নরম বেলেমাটির পাহাড়ে খাঁজ কেটে সাময়িক থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এই রোহিঙ্গাদের। কিন্তু বর্ষা নামলে? সামান্য ক’টা দিনের মুষলধারে বৃষ্টি হলেই এসব জুভেনাইল পাহাড়ের ঢালে ঢালে ধ্বস অবশ্যম্ভাবী।
সামান্য জায়গায় এত মানুষ থাকার জন্য সব পাহাড়ের তৃণমূল পর্যন্ত কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে, সব ক’টা ঢাল এখন ন্যাড়া। অ্যাসেস করে দেখা গেছে, অন্ততঃ পাঁচ লক্ষ মানুষের জীবন হুমকির মুখে। এই এলাকা মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হবে। আমাদের সকল সাফল্য নির্মম কলঙ্কিত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। দুশ্চিন্তায় কয়েকরাত ঘুমুতে পারলাম না। শুরু করলাম উপায় খোঁজা।
হাতে আছে মাত্র চার মাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকার একটা আমাদের এই সুজলা বাংলাদেশ। কিভাবে ঠেকান যায় এই ভূমিধ্বস। গত বছর বিলেতে থাকতেই পাহাড় ধ্বস ঠেকানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে খোঁজখবর করা শুরু করেছিলাম। দেখলাম বিলেতের পদ্ধতিগুলো জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ আর ওদের দেশের পাহাড়গুলো পাথুরে (Rocky) হওয়ায় আমার দেশে সেগুলো কার্যকর হবে না।
বুয়েটের একটা পেইজে এসব নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। জানতে পারলাম, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগেরই একজন অধ্যাপক পাহাড়ধ্বস ঠেকাতে ভাটিভার বা বিন্না নামে একটি ঘাসের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সেটাকে আশাতীত কার্যকর হিসেবে পেয়েছেন। শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম এই ঘাসের স্ট্রেংথ নিয়ে গবেষণা করে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন।
ঘাসটি বেশ অভিনব। মাত্র ৪-৬ মাসেই মাটির দশ ফুট গভীরে এর শেকড় প্রোথিত হয়, চারপাশেও ছড়ায় অনেক এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশেও এর টিকে থাকার ক্ষমতার জুড়ি মেলা ভার। হিম ঠান্ডা কিংবা খরতাপ-সব পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এ ঘাসের। মাইনাস ১৫ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে। আবার অনাবৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে না, পানিতে ডুবে থাকলেও পচে যায় না। আগুন, পোকামাকড় ও রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়ার ক্ষমতা একে প্রকৃতিই দিয়েছে। আর লবণাক্ততায় টিকে থাকতে পারে বলে সমুদ্রতীরের এলাকায় বাঁধ রক্ষায় ভেটিভার সহজেই ব্যবহার করা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এ ঘাসের একটা শেকড়ের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ছয়টা শেকড় একসঙ্গে করলে এটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী। প্রাচীন তামিল পুঁথিতে ঘাসটির ঔষধি গুণের কথা বলা আছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ বইতে খসখসের শরবত পানের উল্লেখ আছে। জনপ্রিয় পানীয় রুহ আফজার একটি উপাদানও বিন্না ঘাস। ভেটিভারের নির্যাসযুক্ত চা খায় অনেক দেশের লোক। আজও এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু এলাকায় ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় খসখস। ভারতে ব্যবহৃত হয় ঘর ঠাণ্ডা রাখার উদ্দেশ্যে।
একটি রকম এমন, বিন্নার শেকড় দিয়ে মাদুর বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সদর দরজায়। নিয়মিত বিরতিতে পানি ছিটিয়ে মাদুরটি ভিজিয়ে রাখা হয়। বাতাস বইলে ঘর তো ঠান্ডা হয়ই, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধ। এ ছাড়া এই ঘাস কাগজ ও পার্টিক্যাল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল। এর শক্ত শেকড় দড়ি, টুপি, ঝুড়ি, মাদুর, চেয়ারেও লাগে। আবার জৈব সার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।
বিন্না ঘাস একদিকে যেমন গবাদি পশুর খাদ্য, আবার এর পাতা দিয়ে জুতা, ব্যাগ, ঘরের চালা, ট্রে, কুশন ও বালিশের কভার, বিছানার চাদর, শৌখিন কার্ড, টেবিলের রানারসহ অনেক আকর্ষণীয় হস্তশিল্প বানানো হয় বাণিজ্যিকভাবে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ বিন্না ঘাস দিয়ে বানানো সামগ্রী রপ্তানিও করছে।
লাগালাম খোঁজ। এই জিনিস আমার চাই-ই চাই। এই ঘাসের বীজ নেই। মাটিতে মূল, কন্দ বা মোথা রোপণ করে বিস্তার করাতে হয়। স্যারের কাছে বেশি চারাও নেই। আরও দুঃখের বিষয়, গোটা চট্টগ্রামে কেউ খোঁজ দিতে পারল না, যদিও আমাদের প্রায় সব পাহাড় আছে শুধু এখানেই। অথচ পাহাড়ে ধ্বস ঠেকানোর জন্য এটাই সেরা উপায়; সবচেয়ে কম খরুচে, সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে কার্যকর। সবাইকে বলতে শুরু করলাম, অনুরোধ করতে শুরু করলাম। এই এক মাসে আমি অন্ততঃ হাজারখানেক মানুষকে এই ঘাস দেবার/লাগাবার অনুরোধ করেছি, যারা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ হিসেবে শীতবস্ত্র, খাবার, টাকা এনেছেন। তাঁদের বলেছি সব বাদ দিয়ে এখন ভাটিভার চারা এনে দিন।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঢাকাস্থ বেড়িবাঁধের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হল ভাটিভার চারা। এনেই লাগিয়ে ফেললাম কুতুপালংয়ের রিফিউজি ক্যাম্পের পাহাড়ের ঢালে। খুব দ্রুত আমাদের এই ঘাস লাগিয়ে ফেলতে হবে হাজার হাজার একরের সবুজ নির্মূল করে ফেলা ন্যাড়া পার্বত্য বনভূমে। নয়ত এদের মৃত্যু ঠেকানো দুরূহ হবে। এই ঘাসের গোড়ায় দেওয়া হবে রোহিঙ্গাদের শৌচাগার থেকে সংগৃহীত বর্জ্য যা ডিস্লাজ করে সারে পরিণত করতে শুরু করেছে ব্র্যাক এবং প্র্যাক্টিকাল অ্যাকশন বাংলাদেশ।
দেড় মাস ধরে যার পেছনে লেগেছিলাম, তা আজ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হল। আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞাস করেছিল, এই বছরে আমি কি কি করতে চাই। আমি বলেছিলাম, আমি পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে চাই। এই মহাযজ্ঞ ছোটখাট কিছু নয়। একার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি নিঃসঙ্গ শেরপা। সবার সহযোগিতা দরকার। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে এখানে কর্মরত সব প্রতিষ্ঠানকে আমি প্রতিটা সভায় অনুরোধ করেছি এই ঘাস লাগাবার জন্য। আশার কথা, সাড়া মিলছে। কিন্তু ইনিশিয়েটিভ দরকার। এখন চারা লাগাতে পারলে, আশা করি, সামনের বর্ষাতেই আমরা ঠেকিয়ে দিতে পারব এই কুতুপালংয়ের অর্ধমিলিয়ন অসহায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল।
রোহিঙ্গারা নিজেরাই চারা লাগিয়ে নেবে, বিনা পারিশ্রমিকে। অন্যান্য পাহাড়েও যেন এই বিন্না ঘাস ব্যাপক হারে লাগানো হয়, সে ব্যাপারেও আমি সবাইকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি। এই ঘাসটির বীজ স্টেরাইল, অনুর্বর, গাছ গজায় না। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে কোনভাবে ফারটাইল বা উর্বর করা যায় কি না তা নিয়ে গবেষণা দরকার। তা সম্ভব হলে, বীজ ছিটিয়ে দিলেই এই ঘাস ঢালে ছেয়ে যাবে, চারা বপনের ক্লেশ থাকবে না। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় কৃষিবিদদের প্রতি বিনীত অনুরোধ বিষয়টি ভেবে দেখবার। তাঁরা ইতোমধ্যেই অনেক স্টেরাইল বীজকে ফার্টাইল করে ফেলেছেন। দেশ বিদেশ থেকে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তাঁরা যেন বিন্নার চারা নিয়ে আসেন, সেই অনুরোধও রাখছি। পাহাড় ধ্বসে একটি প্রাণও যেন না ঝরে যায়, সেই প্রত্যয় নিয়ে শুরু করি যাত্রা, সবাই মিলে।
লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
সুত্র, ঢাকা টাইমস্
পাঠকের মতামত