মো: বজলুর রশীদ::
বৌদ্ধধর্মের বাণী ‘অহিংসা পরম ধর্ম’, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এখন সম্ভবত আর কার্যকর নেই। হিংসাই এখন মূল উপজীব্য। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অহিংসার পরিবর্তে সহিংসতাকে বেছে নিয়েছে। গেরুয়া পোশাকধারীরা যখন সহিংস আন্দোলন করে, তখন তাদের ধর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগে। আমার এক পরিচিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি পুলিশ সার্ভিস থেকে অবসরের পর গেরুয়া পোশাক পরে বৌদ্ধমন্দিরে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি গেরুয়া পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কেন এমন করলেন? বলেছিলেন, ‘আমাকে প্রধান ভান্তে (পুরোহিত) বলেন যে, আমাদের সীমানায় দুটি বাড়ি উঠিয়েছে। (ওইগুলো গরিব বৌদ্ধদের) সেগুলো যেন ভেঙে দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, ‘তুমি পুলিশে ছিলে; এখন এই কাজটি করো।’ তিনি মিনতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এসব ছেড়ে ধর্মকর্ম করার জন্য গেরুয়া পোশাক পরেছি। আমি গরিব মানুষের এসব আশ্রয়ের ঘর ভেঙে দিতে পারব না।’ এটাই ছিল গেরুয়া পোশাক ছাড়ার ইতিবৃত্ত। এখন মিয়ানমারের কিছু বৌদ্ধভিক্ষুর মিশন হলো, এমন সহিংস নীতি। সংসারত্যাগীরা এখন হিংসা ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। মিয়ানমারের এমনই এক ভিক্ষু সংগঠনের নাম মা বা থা।
মা বা থা, মূল নামের সংক্ষিপ্তাংশ। ইংরেজিতে অর্থ দাঁড়ায়, ধর্ম ও জাতিসত্তা রক্ষার সংগঠন বা সংস্থা। ইংরেজিতে এটিকে পিএবিও বলা হয়। সংস্থার একটি শক্তিশালী কমিটি আছে, যা বর্মি জাতীয়তা ও ধর্মকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ২৭ জুন ২০১৩ সালে মা বা থা জন্মলাভ করে। ভিক্ষুদের এই সংগঠনটি অনুরূপ দেশী ও বিদেশী ভিক্ষুদের সাথেও কাজ করে এবং একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
যেমন ৯৬৯ মুভমেন্ট ও শ্রীলঙ্কার বুদু বালা সেনা। ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি মান্দালেতে ভিক্ষুরা সমবেত হয়ে বার্মায় থেরাভাদা বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ রক্ষার জন্য কাজ করার শপথ নেন। মা বা থার কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৫২ জন সদস্য রয়েছে। অশ্বিন বিরাথু মা বা থার নামকরা সক্রিয় সদস্য ছিলেন, যিনি পরে মা বা থার ভাইস চেয়ারম্যান পদ লাভ করেন। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সংসারবিরাগী, ভোগবিলাস ত্যাগী ভিক্ষুরা রাজনীতির আসর গরম করে তোলেন। তারা অং সান সু চির রাজনৈতিক প্লাটফর্ম এনএলডির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন।
মা বা থা অভিযোগ করে, অং সান সু চি বৌদ্ধ মতাদর্শের বিরোধী এবং মুসলমানদের পক্ষের নেত্রী। নির্বাচনের সময় বাস্তবেও দেখা গেল, মিয়ানমারের মুসলমানেরা একচেটিয়াভাবে সু চির এনএলডিকে সাপোর্ট দিয়েছে। সমালোচকেরা অভিযোগ করেন, মা বা থার পেছনে সামরিক শাসকেরা রয়েছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে সহিংস আন্দোলন হলে প্রয়োজনে ভিক্ষুরা যেন গুলি চালাতে পারেন সেজন্য গোপন সামরিক প্রশিক্ষণও তারা পেয়েছেন। এখনো এসব ‘সিক্রেট’ বিষয়। ফলে সু চি তাদের বিরুদ্ধে সামনাসামনি সঙ্ঘাতে যেতে পারছেন না। অপর দিকে, মা বা থা সু চির বিরুদ্ধে অবস্থানকে আরো সংহত করছিল। কিন্তু নির্বাচনে সু চি জয়লাভ করলে মা বা থা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। অহিংসা থেকে সহিংসার পথ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দিকে এগোয়।
সু চির উত্থানের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মা বা থার পতন হবে। কিন্তু মা বা থা রয়েই গেল, আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তবে নির্বাচনের পর বেশ কিছু দিন মা বা থার কর্মীরা এবং অশ্বিন বিরাথু প্রায় আত্মগোপন করেছিলেন। পরে ভিক্ষুরা সরাসরি রোহিঙ্গা নিধনে নেমে পড়েন, সাথে উগ্র বৌদ্ধরা অংশ নিলো। বিশেষ করে ৬০ শতাংশ যুবক মা বা থার সাথে লুণ্ঠন-হত্যায় অংশ নিলো। সেনাবাহিনীর লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। পরে একসময় সেনাবাহিনীই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। সু চি প্রতিবাদ করতে সাহস করলেন না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো। সু চির ভয়, কখন মা বা থা, সেনা শাসক ও ডেমোক্রেটরা মিলে একজোট হয়ে অভ্যুত্থান করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে এবং গণতন্ত্রের নামে সামরিক নেতারা পছন্দজনকে ক্ষমতায় বসাবেন।
মিয়ানমারে বৌদ্ধভিক্ষুদের বড় সংগঠন হলো প্যাট্রিয়োটিক মিয়ানমার মঙ্কস ইউনিয়ন ও মিয়ানমার ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক। এরাও বিরাথুর আন্দোলনকে সমর্থন করে। এসব সংগঠন মিয়ানমারে গোলযোগ বাধাতে থাকে। ইয়াঙ্গুনে তারা জোর করে চারটি মাদরাসা বন্ধ করে দেয়। মুসলমানদের উৎসব পালনে বাধা দেয়। শোয়েদাগন প্যাগোডার কাছে অবস্থিত মুসলমানদের দোকানগুলো উচ্ছেদ করে। মুসলমানদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালায়। ধর্মমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রী অং কোর বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করে যে, তিনি মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছেন।
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হলেও চার বছর ধরে মা বা থা রোহিঙ্গাবিরোধী, মুসলিমবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ও মানবতাবিরোধী যেসব মতবাদ ছড়িয়েছে, তার মূল এত সহজে উৎপাটিত তো হচ্ছেই না; বরং বর্মি সমাজের অনেক লোক এগুলো পছন্দও করছে। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষবাষ্প প্রবাহিত হচ্ছে। ভিক্ষু পরিচালিত হলেও মা বা থার অনেক সাধারণ নাগরিক সদস্য আছে। মূলত অভিক্ষুদের নিয়ে মা বা থা একটি অ্যাসোসিয়েশন বানিয়েছে, তার নাম ‘সত্য পথের স্বদেশপ্রেমী সংস্থা’ সরাসরি যে সব হিংসাত্মক কাজ ভিক্ষুদের দিয়ে করানো ‘মানানসই’ নয় সেগুলো এদের দিয়ে করানো হয়। মা বা থার পরিণতি কী, তা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।
অশ্বিন বিরাথু তেমন লেখাপড়া জানেন না। ১৪ বছর বয়সে পরীক্ষায় ফেল করার কারণে স্কুল থেকে পলাতক হয়ে ভিক্ষু সাজেন। ২০০১ সালে তিনি ৯৬৯ সংগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০০৫ সালে তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া সত্ত্বেও ২০১০ সালে তাকে মুক্ত করা হয়। তাকে বার্মার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীও বলা হয়। তার কথাবার্তায় জ্ঞানের ছাপ নেই এবং ভাষা কর্কশ ও নি¤œমানের।
বিরাথু ২০১৫ সালে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি ইয়াংহি লি কে বলেছেন একজন ‘পতিতা’। মিয়ানমার সরকারের মুসলিম উপদেষ্টা কো নি ইনকে যারা হত্যা করে তিনি ফেসবুকে তাদের ধন্যবাদ জানান। মনে করা হচ্ছে, এ হত্যার পেছনে তার লোকজন জড়িত। ওই সময় তিনি মহিলাদের সমাবেশে মন্তব্য করেন, ‘মুসলমানকে বিয়ে করার চেয়ে কুকুরকে বিয়ে করা ভালো।’ সাধারণত ভিক্ষুরা যখন বক্তব্য দেন তা জগৎ ও জীবন থেকে মুক্তির পথনির্দেশনামূলক হয়, যাতে একজন মানুষ ‘নির্বাণ’ লাভ করতে পারে এবং আলোর সন্ধান পায়। মানুষ পরিশুদ্ধ হয়ে বিশ্বপ্রেমিক হতে পারে। সব মানুষ ও জীবকে ভালোবাসতে পারে। তাদের কল্যাণ কামনা করতে পারে। কিন্তু বিরাথুর বক্তব্য হিংসাত্মক, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে দেয়াই তার ‘মহান’ ব্রত। এসব কিছু বৌদ্ধ ধর্মমতের সাথে সাংঘর্ষিক।
মান্দালে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। এখানের মুসলমানেরা ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী। এরা হাজার বছর ধরে মান্দালেতে বসবাস করে আসছেন। মান্দালেতে চীনারাও ব্যবসা করে। মিয়ানমার-চীন ব্যবসার বড় বড় সংস্থা এখানে অবস্থিত।
মান্দালেতে শ’খানেক গোল্ডেন প্যাগোডা রয়েছে। বৌদ্ধদের জন্য এটা যেন এক তীর্থভূমি। এখানে রয়েছে হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ ও খ্রিষ্টানদের চার্চ। ব্রিটিশ শাসনের সময় আর্মেনিয়ার মুসলমান ব্যবসায়ী, ইরাকি ইহুদি ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেকে ব্যবসা ও বসবাসের জন্য এ শহরের গোড়াপত্তন করে। বার্মা সরকার এ শহরকে বৌদ্ধদের হৃৎপিণ্ড বলে। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে মান্দালে বিশেষ সম্মানের। বিরাথু কাজকর্ম এখানেই শুরু করেছেন যেন তাড়াতাড়ি তার সহিংসনীতি বৌদ্ধসমাজে প্রবেশ করে। তার সহিংসার বাণী অজ্ঞ ও মদ্যপ বর্মিরা লুফে নেয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়িয়ে পড়ায় মান্দালের মুসলমান ঘরবাড়িগুলোর চার দিকে টিনের বেড়া ও পাকা দেয়াল নির্মাণ করা হতে থাকে। কোথাও কোথাও কয়েকটি বাড়ি একসাথে বেড়া দিয়ে মুসলমানেরা দিনাতিপাত করতে থাকে। নগরীর বেশির ভাগ লোক মা বা থাকে এড়িয়ে চললেও ২০১৩ সালে ৯৬৯ আন্দোলনের কাছ থেকে চাপ পেতে থাকে। মুসলমানদের দোকান বা ব্যবসাকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেয়া হয়।
মান্দালেতে ২০১৪ সালে উগ্র বৌদ্ধরা মুসলমানদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বড় বড় দা ও ছুরি নিয়ে তারা মুসলমানের বাড়ি ঘেরাও এবং মারধর করে। তখন দু’জন মুসলমান নিহত হন। তাদের অভিযোগ এক বর্মি মহিলাকে জনৈক মুসলমান ধর্ষণ করেছে। মুসলমান নেতারা বলেন, ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য, ঢালাওভাবে সাধারণত নিরপরাধ মুসলমানদের ওপর কেন হামলা? এভাবে ছোটখাটো ও বিছিন্ন ঘটনাকে মা বা থা পুঁজি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিষোদগার করতে থাকে। মূলত ২০১৪ সালের পর মিয়ানমারের মান্দালে ও মংডু-আকিয়াবে শান্তি বিনষ্ট হতে থাকে। মান্দালেতে বিরাথুর অফিস কক্ষ যেন একটি ‘ওয়ার রুম’।
মুসলমানদের নিগ্রহের জন্য তিনি রাখাইন স্টেটের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিশেষ টার্গেট করেছেন। প্রচার করতে থাকেন ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। এরা বাংলাদেশের অভিবাসী।’ কী অবাক করার বিষয়, সু চিও এখন মা বা থার সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলছেন।
সু চি তার ক্ষমতাকে সংহত করতে তাদের সাথে একাকার হয়ে গেছেন নির্বাচনের আগে যারা তাকে লাল পতাকা দেখিয়েছিল। ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে লুট-মার শুরু হলে তাদের পৃথকভাবে ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল ও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। এখন সেখানেও নিরাপত্তা নেই। সবাই মনে করে বিরাথুর সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণা-বক্তব্য বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্য সম্প্রীতি ও শান্তির বন্ধন ছিন্ন করেছে। সাংবাদিক ডেভিড মেথিসন, যিনি রেঙ্গুনে কাজ করেন, বলেছেন, বিরাথু বৌদ্ধ নীতিবাদ ও বৌদ্ধধর্মের মূলনীতি ফুটো করে দিয়েছেন। তিনি নিজের ইমেজকে বড় করার জন্য অহিংসার বদলে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছেন। মনে রাখা দরকার সম্মিলিত ভিক্ষুদের শক্তি কম নয়। ২০০৭ সালে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ‘গেরুয়া বিপ্লব’ হয়েছিল।
মিয়ানমারের ধর্ম মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে চারটি বিতর্কিত বিল আনে। ধর্মান্তকরণ নিষিদ্ধ করা, আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিষিদ্ধ করা, এক বিয়ে বাধ্যতামূলক করা এবং মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। মূলত এই বিষয়গুলো মিয়ানমার সরকারকে মা বা থা দাবি আকারে পেশ করে এবং সরকারকে দাবি মেনে নেয়ার জন্য বিভিন্ন বৌদ্ধভিক্ষুর বড় বড় আশ্রমসহ শহরে প্রচারণা চালায়। উগ্র ভিক্ষুদের এই স্লোগানগুলো উগ্র বৌদ্ধরা লুফে নেয় এবং একাত্মতা প্রকাশ করে।
অথচ এই চারটি দাবিই মিয়ানমারে এবং আন্তর্জাতিকভাবে খুব বেশি সমালোচিত হয়েছে। ভিক্ষুদের বৌদ্ধ সমাজে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়, ফলে মা বা থার প্রকাশ ও প্রচরণা খুব তাড়াতাড়ি সমাজের ভেতরে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারে দীর্ঘ দিন সেনা শাসন ছিল বিধায় রাজনীতিবিদেরা সেখানে রাজনীতি চর্চার সুযোগ পাননি। অং সান সু চির পর মা বা থা আন্দোলনে অনেকেই একাত্ম হয়। মিয়ানমারের নি¤œ পরিষদ দু’টি বিলে সম্মতি দেয় এবং ২০১৫ সালের মে মাসে জনসংখ্য নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ তৈরি করার পদক্ষেপ নেয়। সংস্থাটি জন্ম নেয়ার পরপরই কাতারভিত্তিক একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
মা বা থার দাবিগুলো মূলত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ সাধারণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রণীত। শতকরা ৩০ ভাগ রোহিঙ্গা দু’টি বা তিনটি বিয়ে করে তাদের সম্পদের কারণে। তাদের রয়েছে জমিজমা, বিস্তর ক্ষেতের কাজ; প্রচুর গরু-মহিষ পালে রোহিঙ্গারা। তাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ছিন্নমূল নয়। তাদের সংসার ও সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য একাধিক বিয়ে করতে হয়। এটা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত ও ‘এক বিয়ে’ আইন চালু করার দাবি রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণœ করেছে। কিন্তু মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি রোধ করতে ভিক্ষুরা সরকারকে চাপ দিতে থাকেন। তুলনামূলক রাখাইনরা ও স্থানীয় মগরা অলস ও মদ্যপ। তাদের সমাজের মেয়েরা প্রচুর কাজ করে, উপার্জন করে আর পুরুষরা ভোগবিলাসী।
তাই বর্মি পুরুষদের প্রতি বর্মি মহিলাদের রয়েছে এক প্রচ্ছন্ন ঘৃণাবোধ। সুযোগ পেলেই রাখাইন মহিলারা রোহিঙ্গা পুরুষদের বিয়ে করে। এরা সংখ্যা কম নয়। তা ছাড়াও এটি একটি সাধারণ মানবাধিকার। কিন্তু মা বা থা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ এবং আন্দোলন শুরু করে। বিভিন্ন সময় পুরো মিয়ানমারে প্রচুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে কাচিনে বহু লোক খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষিত হয়েছে এবং খোদ ইয়াঙ্গুন, সিত্তুই বা আকিয়াব ও মান্দালেতে শত শত বর্মি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। জাতিগতভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য কাচিনেও এক প্রকার যুদ্ধ চলছে এবং মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে চলছে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান। মা বা থা সরাসরি নিপীড়নের যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার বহু বছর আগে থেকেই মুসলমানদের বিতাড়ন ও ধ্বংসের মতলবে অনেক ঘৃণ্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে এবং বতর্মান সেনাবাহিনীও রোহিঙ্গা নির্মূলে তৎপর রয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে, সু চি, সামরিক বাহিনী, মা বা থা, ৯৬৯ দল, মিয়ানমার মঙ্কস ইউনিয়ন ও মিয়ানমার ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক সবাই এক দেখা যাচ্ছে।
সঙ্ঘ মহানায়ক, রাষ্ট্রীয় অনুমতিপ্রাপ্ত বৌদ্ধভিক্ষুদের সংগঠন। এই সংগঠনের সাথে মা বা থার চরম বিরোধ। মিয়ানমারে বৌদ্ধভিক্ষুদের বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে সরকার সঙ্ঘ মহানায়ককে অনুমতি দিয়েছে। চরমপন্থী বৌদ্ধভিক্ষুরা রাষ্ট্র পরিচালিত সঙ্ঘ মহানায়ক কমিটির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দেশব্যাপী যে সাইনবোর্ড পোস্টার রয়েছে, সেগুলো তুলে ফেলার নির্দেশ রয়েছে। মা বা থার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রায় ২০০০ চরমপন্থী বৌদ্ধভিক্ষু ২৭ মে, ২০১২ দু’দিনব্যাপী মহাসম্মেলন করেছিল ইয়াঙ্গুনে। সেখানে সঙ্ঘ কমিটির নির্দেশ মানবে না বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।
ইসলামোফোবিয়া ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য মিয়ানমার সরকারি কর্তৃপক্ষ মা বা থার নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিলে তারা নাম পরির্বতন করে সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কর্তৃপক্ষ মা বা থাকে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারপরও গেরুয়া পোশাকধারী অহিংস নীতির ধারকেরা সহিংসতার উদ্দেশ্যে অশিক্ষিত লোকজন, সাধুমা ও ভিক্ষুদের নিয়ে ইয়াঙ্গুনে সমাবেশ করে। সেখানে নাম পরিবর্তন করে ‘বুদ্ধা ধম্মা জনহিতৈষী ফাউন্ডেশন’ রাখা হয়। নাম পরিবর্তনের স্মারকে সই করেন ভিক্ষু নেতা তিলকা বিউন থা। এরপর তারা মুসলমানদের দু’টি স্কুল এবং একটি মসজিদ বন্ধ করে দেয়। ফলে স্থানীয় মুসলমানদের সাথে সন্ত্রাসীদের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরের শুরুর দিকে সঙ্ঘ মহানায়ক এক বছরের জন্য বিরাথুকে প্রচার বক্তৃতায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তিনি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন।
তবে ঢালাওভাবে সব ভিক্ষুকে সহিংসতার জন্য দোষারোপ করা যায় না। আলজাজিরার খবরে জানা যায়, মান্দালেতে পুনিয়া নন্দা ভিক্ষুর বিশাল মঠ। সেখানে বৌদ্ধধর্মের নিয়মনীতি কঠিনভাবে পালন করা হয়। ভিক্ষু পুনিয়া নন্দা জানান, তিনি তার মঠে প্রায় এক হাজার মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সহিংসতার পথ খুবই খারাপ।’
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব,
বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার
সুত্র: নয়া দিগন্ত পত্রিকার সৌজন্যে