মাত্র আট মাস বয়স কম থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারেনি শিশু রায়হান আহমেদ সিয়াম। সে চাঁদপুর জেলা সদরের পুরান বাজার রিভারসাইড কিন্ডারগার্টেন থেকে এ বছর পঞ্চম শ্রেণির পাঠ গ্রহণ শেষ করেছে। জেলা সদরের হাসান আলী সরকারি হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে তার বাবা বিপাকে পড়েন। জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী, সিয়ামের বর্তমান বয়স ১০ বছর ৪ মাস। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য বয়স চাওয়া হয়েছে ১১ বছর। আট মাস বয়স কম থাকায় টেলিটকের অনলাইন সফটওয়্যার সিয়ামের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে।
রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে মেয়ে রাফিয়াদ মুনতাহার ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে গিয়েও পারেননি তার মা রফিকা আফরোজ হূদি। জানালেন, তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আট বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে বয়স। তার মেয়ের বয়স তিন মাস কম থাকায় ভর্তি আবেদনের সফটওয়্যার সিস্টেম আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
সিয়াম ও মুনতাহারের মতো সারাদেশের লক্ষাধিক শিশু এবার পছন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারেনি। এ অবস্থার মধ্যেই গতকাল রোববার সারাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদনের সময়সীমা পার হয়েছে। গতকাল আবেদনের শেষ দিনে শত শত অভিভাবক সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অনেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) সশরীরে গিয়েও তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসেন। অনেকে সেখানে কোনো প্রতিকার না পেয়ে ক্ষোভের বিস্ম্ফোরণ ঘটান।
জানা গেছে, বয়স মাত্র কয়েক মাস কম থাকলেও ভর্তি আবেদন গ্রহণ না করার কারণে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের স্কুলে ভর্তি নিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। এতদিন অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হলেও মাউশি কর্তৃপক্ষ এবারই প্রথমবারের মতো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে টেলিটক লিমিটেডের বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে আবেদন গ্রহণ ও ভর্তি লটারির আয়োজন করেছে। আগামী বুধবার এই লটারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অথচ লাখ লাখ ভর্তিচ্ছু শিশু বয়সের ফাঁদে পড়ে এখনও আবেদনই করতে পারেনি।
অভিভাবকরা জানান, ভর্তি আবেদনে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দেখা দিয়েছে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের সার্ভার ডাউন হয়ে যাওয়ায়। গত টানা প্রায় ২৫ দিন ধরে এই সার্ভারে ঢুকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। স্কুলে ভর্তির আবেদনের সঙ্গে ভর্তিচ্ছু শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই সার্ভারে ঢুকতে গেলে বারবার 'ইউর কানেকশন ইজ নট প্রাইভেট' লেখা একটি মেসেজ বারবার স্ট্ক্রিনে ভেসে উঠছে। গতকাল রোববার প্রায় দিনভরই এ অবস্থা ছিল। এতে স্কুলে ভর্তি আবেদনকারী অভিভাবকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জেনারেল (যুগ্ম সচিব) এ কে এম মাসুদুর রহমান রোববার বিকেলে সমকালকে বলেন, আমাদের দুটি সার্ভার রয়েছে। নতুন সার্ভারের বিষয়টি হয়তো অনেকের জানা নেই। পুরোনো সার্ভার একটু স্লো। আর স্কুলে ভর্তির কারণে বহু লোক একসঙ্গে লগইন করার কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তিনি খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যায় লগইন করার জন্য পরামর্শ দেন।
খোদ মাউশিতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, গত ২৫ দিনে তিনি একবারও সার্ভারে ঢুকতে পারেননি। তার ছেলের স্কুলে ভর্তির জন্য তিনি এই সার্ভারে ঢুকতে চেয়েছিলেন। একাধিক অভিভাবক জানান, ভর্তি আবেদনে ভর্তিচ্ছু শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে শিশুর পাসপোর্ট থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না। আবেদনের সফটওয়্যারে পাসপোর্টের নম্বর দেওয়ার কোনো অপশনই রাখা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বয়সের মারপ্যাঁচে শিশুদের ভর্তির আবেদন নির্ধারিত সফটওয়্যার গ্রহণ না করায় অনেক অভিভাবক কৌশলী হয়ে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করেন। শিশুর নামে আকার, হ্রস্ব-ই কার এদিক-সেদিক করে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করেন। এরপর ভর্তির আবেদন করেন। সরকারি স্কুলে ভর্তি নীতিমালায় শিক্ষার্থীর বয়সের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর বয়স ৬ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। সে হিসাবে দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণির ভর্তির বয়স নির্ধারিত হবে। তবে ভর্তির বয়সের ঊর্ধ্বসীমা সংশ্নিষ্ট বিদ্যালয় নির্ধারণ করবে। শিক্ষার্থীর বয়স নির্ধারণের জন্য ভর্তির আবেদন ফরমের সঙ্গে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হবে।
মাউশির উপপরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন সমকালকে বলেন, বয়সের বিষয়টি নিয়ে অনেকে তাদের কাছে এসেছিলেন। তবে এ বিষয়ে মাউশির করণীয় কিছু নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করা ভর্তির নীতিমালা অনুসরণ করে ভর্তি করা হচ্ছে। এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ৬+ হতে হবে। তারা টেলিটককে আবেদন গ্রহণ ও লটারির দায়িত্ব দিয়েছে। সফটওয়্যারে তাই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ৬+ দেওয়া আছে। এর কম বয়স হলে সফটওয়্যার তা নেবে না। এভাবে উপরের প্রতিটি শ্রেণিতে বয়স এক বছর করে বাড়বে।
মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন জানান, সারাদেশে মোট ৬৮৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৬টিতে অনলাইনে ভর্তির আবেদন নেওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত মোট ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৪টি আবেদন জমা পড়েছে। সংশ্নিষ্টরা জানান, ভর্তিচ্ছু সব শিশু আবেদন করতে পারলে এ সংখ্যা অন্তত ৬ লাখ ছাড়িয়ে যেত।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং স্কুলে ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তিচ্ছুদের এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভর্তি নিয়ে তালগোল সৃষ্টি হয়েছে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডে একটি কম্পিউটারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক অভিভাবক জানান, তার মেয়েকে ভর্তির জন্য ভিকারুননিসায় আবেদন করবেন। কিন্তু ভিকারুননিসার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৫ দিন কম আছে, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম তারিখ। এ জন্য তিনি নতুন জন্ম নিবন্ধন করার জন্য দোকানে এসেছেন। এমনটা করা কতটা নৈতিক? জানতে চাইলে বলেন, পনেরো দিন-এক মাস বয়স বাড়ানো-কমানোয় কোনো সমস্যা নেই। নয়তো আমার মেয়েকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক অভিভাবক জানান, আগে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছিলেন, এটি সংশোধনের সুযোগ নেই। তাই তিনি ম্যানুয়াল একটি জন্মসনদ সংগ্রহ করেছেন তার স্থানীয় পৌরসভা কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া সমকালকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে- 'যাদের জন্ম ১ জানুয়ারি, ২০১৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর মধ্যে তারাই আবেদন করতে পারবে প্রথম শ্রেণিতে।' প্রার্থীর নিবন্ধনকৃত পূর্ণ নাম এবং সনদপত্র অনুযায়ী পিতা-মাতার পূর্ণ নাম উল্লেখ করতে হবে। ভর্তিকৃত ছাত্রী বা তার পিতা-মাতার নামের কোনো অংশ পরবর্তী সময়ে কোনো ক্রমেই পরিবর্তন করা যাবে না।'
রাজধানীর আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম মোস্তফা কামাল বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথম শ্রেণির বয়স ৬ বছরের ঊর্ধ্বে বলা হয়েছে। সেটার সঙ্গে সংগতি রেখে ভর্তি নীতিমালা। তবে দু-এক মাসের কম-বেশি ছাড় দেওয়া যেত। ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ৬ বছর ভর্তির বয়স আগেও ছিল, তখন প্রথম শ্রেণিতে লটারিতে কেউ টিকে গেলেও আমরা ভর্তি নিতাম না। তখন অভিভাবকরা জন্মনিবন্ধন সনদ সংশোধন করে এনে দেখাতেন। এবার যান্ত্রিকভাবে সবকিছু করতে গিয়ে হয়তো একটু ঝামেলা হয়েছে।
আনোয়ারুল আজিম নামে এক অভিভাবক বলেন, রাজধানীর সব নামিদামি স্কুলই তো প্রথম শ্রেণিতে ৫+ বয়সী শিশু ভর্তি নিচ্ছে। সরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য তাহলে কেন আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে? তাহমিনা বেগম নামের আরেক অভিভাবক বলেন, যারা কম বয়সে স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে তারা এখনই সমস্যায় পড়ছে না। যারা স্কুল পরিবর্তন করতে চাইছে তারাই এ বছর সমস্যায় পড়েছে। তবে সব শিশুই সমস্যায় পড়বে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে গিয়ে বোর্ড রেজিস্ট্রেশনের সময়ে। বয়স কম থাকায় বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী বোর্ড রেজিস্ট্রেশন থেকে বঞ্চিত হবে ও ঝরে পড়বে। তখন এ সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
সার্বিক এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী সমকালকে বলেন, প্রথমবারের মতো যান্ত্রিক উপায়ে এগুলোর ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। যারা এগুলো পরিচালনা করছেন তারা কি এসব সমস্যা আগে ভেবে দেখেননি? বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির বাইরে থেকে গেলে তা মহাবিপদের কারণ হবে। বয়সের দু-এক মাসের হেরফের বিষয়ে আরও সহনশীল থাকা যেত। সরকার যখন সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে ক্লাস্টার ও ক্যাচমেন্ট এরিয়া বাড়িয়েছে, আরও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে তখন এ ধরনের খবর আমাদের হতাশ করে। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ভর্তি আবেদনের সময় আরও বাড়িয়ে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রযুক্তিকে শিক্ষার্থীবান্ধব না করা গেলে আমরা হোঁচট খাব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলব।