নির্বাচনী ডামাডোল আর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের পর্যটন খাত যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। জনপ্রিয় স্পটগুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে পর্যটক উপস্থিতি। এমনকি জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা দেশে হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টগুলোতে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা অলস সময় পার করছেন। গুনছেন লোকসান ।
দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারের রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি নিরাপত্তা অজুহাতে এবারও বন্ধ রাখা হয়েছে থার্টিফার্স্ট নাইট অনুষ্ঠান। ফলে এ বছরও পর্যটন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। একই অবস্থা বান্দরবান, রাঙামাটি, সুন্দরবন, সিলেট এবং শ্রীমঙ্গলেও।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশীয় পর্যটকের ওপরই টিকে আছে পর্যটন শিল্প। তাদের ৯০ শতাংশের বেশি বাসে বা ট্রেনে চলাফেরা করেন। সম্প্রতি বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে বাস-ট্রেনে আগুন ও হতাহতের ঘটনায় স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। ফলে তারা নির্ধারিত ভ্রমণ এবং অগ্রিম বুকিংও বাতিল করেছেন। এতে ভরা মৌসুমেও শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আক্ষেপ নিয়ে তারা জানান, যদি জানুয়ারির পরেও নাশকতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকে, তাহলে পর্যটন ব্যবসার এ নিম্নমুখী অবস্থা থেকে উত্তরণের সাময়িক কোনো সম্ভাবনা নেই।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুর রউফ কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচনের কারণে দেশি পর্যটকের সংখ্যা ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে। তারা অধিকাংশই ভ্রমণ করেন বাস বা ট্রেনে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি ঢাকা-কক্সবাজার রুটের রেললাইন
ক্ষতিগ্রস্ত করার ঘটনাও পর্যটকদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সে কারণে এই মুহূর্তে ট্রেনে ভ্রমণকে নিরাপদ মনে করছেন না অনেকেই।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা কারণে কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে থার্টিফাস্ট নাইট অনুষ্ঠান। এবারও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সৈকতে উন্মুক্ত অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকরা চাইলে রাত ১ থেকে ২টা পর্যন্ত ঘুরতে পারবেন সৈকতে। সে সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে থাকবে; কিন্তু রাত ১০টার পর হোটেলের সব বার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় হোটেলে মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, আগে সৈকতে বা বর্ষবরণের আয়োজন করা হতো। তারকা হোটেলগুলোতে থাকত ইনডোর প্রোগ্রাম; কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর শুধু লোকসান গুনে যাচ্ছি।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সবাই মিলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থার্টিফাস্ট ও নিউ ইয়ারের অনুষ্ঠান করা গেলে কয়েকশ কোটি টাকা লাভ হতো।
টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ বলেন, নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের কোথাও আতশবাজি কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। বিধিনিষেধ পালনে টুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকবে।
কক্সবাজারের তিন তারকা মানের একটি হোটেলের পরিচালক এ প্রতিবেদককে টেলিফোনে জানান, হোটেলের আড়াইশ রুমের মধ্যে চার-পাঁচ দিন আগে ৩০ রুম ভাড়া ছিল। এখন পর্যন্ত আরও ৭টি রুম ভাড়া হয়েছে। কিছু করপোরেট বুকিং ছিল তারাও আসতে চাচ্ছে না।
এদিকে, বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলোও প্রায় জনশূন্য। আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কালবেলাকে জানান, অবরোধ-হরতালের কারণে হোটেল-মোটেল সব খালি। এর আগে কুকি চিনের কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল। ব্যবসায় মন্দা কাটছেই না।
দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সুন্দরবনের চিত্রও একই। টানা অবরোধ-হরতালের বড় ধরনের লোকসানের মুখে স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর জানান, আগে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যটক আসত। অথচ এখন আসেন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড জানান, তাদের অ্যাসোসিয়েশনে সদস্য ১১২ জন এবং পর্যটকবাহী লঞ্চ বা জাহাজ ৬৫টি। নভেম্বরে অনেকে বুকিং দিয়েছিলেন। এখন টাকা ফেরত চাচ্ছেন। আবার অনেকে নির্বাচন পর্যন্ত বুকিং স্থগিত করছেন।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পরিবার নিয়ে কেউ ঘুরতে আসতে চায় না। নভেম্বর থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু। অথচ এবছর সে মাস থেকেই ঝামেলা। সিজনেই যদি ক্ষতিতে থাকি, তাহলে মৌসুম চলে গেলে এমতিতেও পর্যটক কম আসবে।
পাঠকের মতামত