সুযোগ পেলেই বাঙালি ভাব ধরে এবং দিন রাতের ক্ষণ, ঋতুর পরিবর্তন এবং জোয়ার-ভাটার সাথে পাল্লা দিয়ে বাঙালির ভাবসাব পরিবর্তিত হয়ে যায়। আরো একটি কারণে বাঙালির ভাবের রূপান্তর ঘটে। স্বার্থ লাভের আশা অথবা স্বার্থহানির শঙ্কার কারণে বাঙালি অতি দ্রুত নিজের চেহারা-সুরত, পদ-পদবি এবং পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে ফেলে। প্রয়োজনে নিজেকে সে শাহেন শাহ, রাজা-বাদশাহ কিংবা আমির-ওমরাহ যেমন বানাতে পারে, তেমনি চোখের পলকে কাঙালির রূপ ধারণ করে বাঙালির চরিত্রে কালিমা লেপন করতে তার তুলনা কেবল সে নিজেই। তার এই দুর্বলতার ব্যাপারে কেউ যেনো মুখ খুলতে না পারে সেজন্য তার চেষ্টা-তদবিরের কোনো ঘাটতি থাকে না। মানুষের মুখ বন্ধ করার নিত্যনতুন ফন্দি এবং কায়দা-কানুন সংবলিত এক বিরাট তথ্যবহুল রূপকথার বই সে রচনা করে ফেলে চুপকথা শিরোনামে।
বাঙালির ভাব বোঝার জন্য সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে নামক চলচ্চিত্রটি একটি উত্তম দলিল হিসেবে সর্বজন নন্দিত। ঐতিহাসিক মিনহাজ উস সিরাজ নিবন্ধ প্রাচীন যুগের মহাকবি বান ভট্ট, মধ্যযুগের কবি আলাওলের কবিতা অথবা কবি রাধা রমণের গানে বাঙালির চিরায়ত ভাবের কিছু মানচিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। বাঙালি পেটভরে ভাত খাওয়ার পর ঠোঁটের ওপর হালকা ঘি মেখে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। তারা ভোগের সময় যতটা না উল্লাস প্রকাশ করে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় করে ত্যাগের ক্ষেত্রে। তাদের আনন্দ প্রকাশের উল্লাসের তুলনায় শোক প্রকাশের কোলাহল অনেক তীব্র। তারা স্মরণে রাখার চেয়ে ভুলে যাওয়ার মধ্যে নিজেদের স্বার্থকতা প্রমাণের চেষ্টা করে। খোটা দেওয়ার অভ্যাস এবং ক্ষতস্থানে লবণ ছিটিয়ে সফলতা দেখাবার দাম্ভিকতা তারা নিজেদের জন্য মর্যাদাকর বলে বিবেচনা করে।
বাঙালির আদি এবং অকৃত্রিম কিছু চরিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত প্রয়াত শ্রী নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী। আত্মঘাতী বাঙালি নামক বইয়ে বাঙালির চিরায়ত অভ্যাস, রাজনীতি এবং মন-মানসিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। একই লেখকের বাঙালি জীবনে রমণী বইটিও বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। বাঙালির আহার-বিহার, নিদ্রা, বিনোদন ইত্যাদিতে যেমন স্বতন্ত্র ভাবসাব রয়েছে, তেমনি কলহ-বিবাদ, ঝগড়া-ঝাটি এবং মারামারিতেও বাঙালি আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। গ্রামবাংলায় দুই পরিবারের মেয়েরা যখন উচ্চকণ্ঠে অশ্লীল শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঝগড়া করে, তখন পরিবারের পুরুষ মানুষেরা তা দেখে মজা লাভের চেষ্টা করেÑ তাদের মধ্যে কেউ এগিয়ে গিয়ে ঝগড়া থামাবার চেষ্টা করে না। অন্য দিকে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চায় ঝগড়াটা দীর্ঘ সময় নিয়ে চলুক। এজন্য তারা সিকা দোলাতে থাকে। গ্রামবাংলায় এই বিশ্বাস বহুলভাবে প্রচলিত যে, সিকা দোলালে ঝগড়া থামবে না।
বাঙালির অস্থিরতা এবং ভয় পাওয়ার অদ্ভুত সক্ষমতা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। বাঙালি নদীর স্রোত, বন্যার পানি, ঝড়ো হাওয়া, রাতের আঁধারকে যেমন ভয় পায়, তেমনি ভূত-প্রেম, দৈত্য-দানব, জ্বিন-পরী নিয়ে তাদের আতঙ্ক প্রায়ই মৃত্যু ডেকে আনে। বাঙালি বড় বটগাছের নিচ দিয়ে গভীর রজনীতে একাকী যাওয়ার দুঃসাহস দেখায় না। তারা শ্মশান, কবরস্থান, পরিত্যক্ত দালান-কোঠা, বনজঙ্গল কিংবা বিলের মধ্য দিয়ে চলাফেরার আগে নিজ নিজ ধর্মমতে ভয় দূর করার প্রার্থনা সেরে নেয়। অন্য দিকে, রাতে বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে ওসব এলাকা দিয়ে ভুলক্রমেও চলাফেরা করে না। তাদের ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরে এবং প্রায়ই স্বপ্নে তারা ভয়ঙ্কর ও আজগুবি সব দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে। এ ব্যাপারে আমার একটি শৈশব স্মৃতি এখানে বর্ণনা করার লোভ সামলাতে পারছি না।
আমাদের গ্রামের আলতু মিয়া বেশ প্রভাবশালী এবং ধন্যাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে আশপাশের দশ গ্রাম মাতব্বরি করে বেড়াতেন। টকটকে ফর্সা, গুরুগম্ভীর চেহারা এবং প্রচণ্ড রাগী স্বভাবের জন্য লোকজন তাকে ভীষণ ভয় করত। তিনি সবসময় নিজেকে প্রচণ্ড সাহসী এবং অতীব শক্তিশালী লোক হিসেবে পরিচয় দিতেন। গ্রামবাসীও নির্দ্বিধায় আলুত মিয়ার ভাবসাব মেনে নিত। আলতু মিয়ার মায়ের ছিল মাথা গরমের ক্যামো। সারা দিন মুখ ভার করে বসে থাকতেন এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য পেঁয়াজ, মুসুরির ডাল এবং এলোভেরা একসাথে বেটে মাথায় দিয়ে রাখতেন। তিনি সাধারণত সারা রাত ঘুমাতেন না। অর্ধ তন্দ্রাবস্থায় আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলতেন।
ঘটনার রাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন আলতু মিয়ার মা বিড়বিড় করে আলতু মিয়াকে কাছে ডাকলেন। একে তো বর্ষাকালের মাঝরাত- তার ওপর ভরা আমাবস্যার প্রভাব। প্রচণ্ড ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। সত্তর দশকের গ্রামবাংলার সেই বৃষ্টির শব্দ, রূপ এবং স্বাদ যারা উপভোগ করেননি তারা আলতু মিয়ার বাড়ির সে রাতের দৃশ্য কল্পনাও করতে পারবেন না। আলতু মিয়া বৃষ্টির আবেশে নকশিকাঁথা গায়ে চড়িয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন। মায়ের ডাকে তিনি ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামলেন। হেরিকেনের মৃদু আলোতে দূর থেকে বৃদ্ধা মাকে দেখে তার কাছে মনে হলো অশরীরী কোনো ভূত বা প্রেতের আগমন ঘটেছে এবং তার মায়ের ওপর ভর করেছে। ভয়ে তার কণ্ঠরোধ হওয়ার উপক্রম। তিনি কী করবেন তা স্থির করতে পারলেন না।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন গ্রামবাংলার প্রতিটি বাড়িঘরে রাতে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হতো। চার দিকে ব্যাঙ, ঝিঁ ঝিঁ পোকা, সাপ, বিচ্ছু, বাদুর, চামচিকা এবং শকুনের আনাগোনা ছিল অহরহ। রোগ-বালাই, অভাব অভিযোগ এবং প্রাকৃতিক সুর্যোগ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থাকে দুর্বল করে রাখত। পীর ফকির, সাধু সন্ন্যাসী, দয়াল বাবা, কেবলা বাবা, গণক ঠাকুর প্রভৃতি নাম ধারণ করে কিছু ভণ্ড ও ধুরন্দর মানুষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিথ্যা কেচ্ছা কাহিনী বলে মানুষকে আরো ভয় পাইয়ে দিত। ফলে তাদের তাবিজ, কবজ, ঝাড়ফুঁক, জিন-ভূত তাড়ানোর ব্যবসা এবং তথাকথিত জাদুটোনা বা বান মারার ব্যবসায় সবসময় রমরমা ভাব বিরাজ করত। আলতু মিয়ার বাড়ির একটি তেঁতুল গাছ এবং একটি গাবগাছ নিয়ে গ্রামে নানা কাহিনী প্রচলিত ছিল। আলতু মিয়া বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গাছ দুটো কেটে ফেলার, কিন্তু একবারও সাহস করে উঠতে পারেননি।
তৎকালীন সময়ে শিশু-কিশোরেরা ঘুমের মধ্যে প্রায়ই পেশাব করে বিছানাপাতি নষ্ট করে ফেলত। অন্য দিকে, বড়দের প্রাকৃতিক কর্মের প্রয়োজন হলে পরিবারের আপনজনদের ডেকে তুলত। খুব সাহসী না হলে রাতে কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একাকী বাইরে যেত না। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ জলবিয়োগের কাজটি ঘরের মধ্যে রক্ষিত বিশেষ পাত্রেই সেরে নিত। যেসব বাড়িতে আলতু মিয়াদের মতো বিতর্কিত তেঁতুল গাছ ও গাব গাছ থাকত সেসব বাড়ির লোকদের চরিত্রই ছিল আলাদা। তাদের সাধারণত রাতে বাইরে যাওয়ার অভ্যাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাত আবার সকালে জেগে উঠত। তারা নিজেদের ইন্দ্রিয়গুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল যাতে গভীর রাতে যদি তেঁতুল গাছের ভূত এবং গাব গাছের পেত্নী নেমে এসে তাদের দরজায় কড়াগুলো প্রচণ্ড শব্দে নাড়াত তা হলেও তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত না।
আলতু মিয়া হেরিকেনের মৃদু আলোতে তার মায়ের মুখ দেখে যখন অজানা আতঙ্কে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল, ঠিক তখন তেঁতুল গাছের কয়েকটি বাদুর বিশ্রী শব্দে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। ঘরের মধ্যে কোত্থেকে যেন একটি চামচিকে উড়ে এলো। একটি ভাওয়া ব্যাঙও আলতু মিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় আলতু মিয়া স্থির থাকতে পারলেন না। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলেন- ওরে মা রে! ওরে বাবারে। পুত্রের চিৎকার শুনে মাথা গরম ব্যামোতে আক্রান্ত বৃদ্ধা মা আরো জোরে চিৎকার দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাড়ির অন্য সবাই মা-ছেলের চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টা চিৎকার করে পুরো পরিস্থিতিকে ভৌতিক বানিয়ে ফেলল। তারা সবাই মিলে অমাবস্যার নিশুতি রাতে বহুক্ষণ ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো গ্রাম জাগিয়ে তুলল। সে রাতেই ওঝা এলো, ভিন গ্রাম থেকে জটাধারী ফকিরকেও আনা হলো। ওঝা ও ফকির সমন্বিতভাবে চেষ্টা করে তেঁতুল গাছ ও গাবগাছ থেকে ত্রেত্রিশটি ভূত তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। আলতু মিয়ার ঘটনাটিকে আপনি রূপক অথবা নিছক গল্প- যেভাবেই নেন না কোনো, প্রকৃত ঘটনা হলো সারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে পরিবেশের মধ্যে সত্তর, আশি অথবা নব্বইয়ের দশকে বাঙালি বেড়ে উঠেছে তাতে ভয় পাওয়া এবং ভয় পাইয়ে দেয়ার সংস্কৃতি অনেকের রক্ত-মাংসের সাথে মিশে গেছে। একশ্রেণীর মানুষের ভয়ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে লোভ-লালসার কাঙালরা আদিকালে যেরূপ ঝাড়ফুঁকের ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল, ঠিক তেমনি বর্তমান যমানার কাঙালরা মানুষের দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যে লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতি এবং জুলুম অত্যাচারের ব্যবসা পেতেছে তাতে মনে হচ্ছে বর্তমানের তুলনায় অতীতই বোধ হয় বেশি ভালো ছিল।
আবহমান ঐতিহ্যের বলে বলীয়ান বাঙালী তার প্রেম নিবেদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংকিং, শেয়ারবাজার ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ফলে প্রেম নিবেদনের সুমহান এবং প্রচলিত রীতিনীতির পরিবর্তে চলে এসেছে চাপাতি থেরাপি। প্রেমিকা যদি তার দুর্বৃত্ত প্রেমিকের অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা করে তা হলে চাপাতির আঘাতে পুরো দেহ তছনছ করে দেয়া হবে। বাঙালির রাজনীতির ভাষা এবং ব্যাকরণের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে গেছে। পথ-ঘাট, মাঠ কিংবা চায়ের দোকানের সরব রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা এখন তেঁতুল গাছ অথবা গাব গাছের মাথায় উঠে গেছে। অন্য দিকে, ওসব স্থানে বসবাসকারীরা চলে এসেছে ব্যালট বাক্সের ভেতরে।
অর্থনীতি, ব্যাংকিং, শেয়ারবাজার, জমিজিরেত ক্রয়-বিক্রয়, নিয়োগ-বদলি, পদ-পদবি আজ সবকিছু চলে গেছে কাঙালদের নিয়ন্ত্রণে। আগেকার দিনে ফেরিওয়ালারা যেভাবে হাঁক-ডাক দিয়ে তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে বেড়াত, ঠিক তেমনি বর্তমানকালের কাঙালরা বাঙালির ভাগ্য নিয়ে পথেঘাটে চিৎকার চেঁচামেচি করে প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে দিচ্ছে সর্বোচ্চ দরদাতাদের কাছে।