শেষ পর্যন্ত ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে জাতিসংঘ, সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিক হয়েছে সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশ সরকার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নির্মাণ করেছে ভাসানচর আশ্রয় কেন্দ্র, প্রায় ৮ মাস আগে সেখানে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু হয়। ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের পর থেকেই সরকারের পাশাপাশি জাতীয়-স্থানীয় এনজিওসমূহ নিজস্ব অর্থায়নে সেখানে বিভিন্ন মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত এই মানবিক সহায়তা কর্মসূচির পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় এনজিওগুলোই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে (আইএনজিও) দ্বীপটিতে মানিবক সহায়া পরিচালানার বিষয়ে সরকারের সাথে সংলাপের জণ্য আহ্বান জানিয়েছিলো এবং সেখানে অবিলম্বে মানবিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করেছিল।
প্রায় একবছর আগে সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে)-এর আমন্ত্রণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজ-এ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমি নেদারল্যান্ডের হেগে যাই । কানাডার বিশেষ দূত বব রেইও সেখানে ছিলেন, বব রেইও এখন কানাডায় জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ভাসানচরের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছিলেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবেই সেই বক্তৃতার প্রতিবাদ করি। আমি আমার জন্মস্থান কুতুবদিয়া দ্বীপ সম্পর্কে কথা বলি, কিভাবে এটি তৈরি হয়, সেখানে মানুষের বসতি কিভাবে শুরু হয়, এবং এখনও বর্ষাকালে সমুদ্রের পানির ফলে বন্যায় কিভাবে দ্বীপটির অংশবিশেষ তলিয়ে যায়, কিভাবে সেই দ্বীপের মানুষজন এত কিছুর পরেও টিকে আছে সেই কথা আমি বলেছি। আমি ভোলা জেলার চরগুলো সম্পর্কেও বলি, সেখানে বাধের ব্যবস্থা অপ্রতুল, কিন্তু মানুষ সেখানে বাস করছে। আমি আমার যুক্তি দিয়ে ববকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছিলাম, আমার মূল বক্তৃতা ছিলো- আমাদের সরকার ভাসানচরে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতি সমস্যার সমাধানে ভাসানচরের চেয়ে উত্তম বিকল্প কী থাকতে পারে?
এমনকি কিছু দিন আগে, কক্সবাজার এবং ঢাকায় চারটি দাতা সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে আমি বিষয়টি আবার উত্থাপন করেছি এবং তাদেরকে আমাদের সরকারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য আহবান জানিয়েছি এবং সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর অনুরোধ আমি সেখানে রাখি। অবশেষে সেই অচলাবস্থার অবসান হয়েছে। বিষযটি আমাদের সবার জন্যই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সর্বাগ্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ভাসানচরের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগগুলোর পক্ষে সবার আগে জাতীয়-স্থানীয় এনজিওগুলোই অবস্থান নেয়, নিজস্ব অর্থায়নে সেখানে তাঁরা সরকারের পাশাপাশি বেশ কিছু মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং সরকারের সেই উদ্যোগে আইএনজিও ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে সমর্থন দেওয়্রা জন্য এডভোকেসি করে। আমি দেখেছি, জাতীয়-স্থানীয় এনজিওগুলো বিশেষ করে দেশের বাইরে বা বিদেশীদের সামনে আমাদের সরকারের সমালোচনা খুব কমই করে থাকে। কক্সবাজারের স্থানীয় এনজিওরাই উখিয়া ও টেকনাফে সবার আগে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা নিয়ে হাজির হয়। অন্তত প্রথম মাস সেখানে কোনও আইএনজিও বা জাতিসংঘের কোনও সংস্থা ছিলো না বললেই চলে।
আমি এখানে এই বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরছি কারণ, কারণ সরকারী কর্মকর্তা, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের কাছে স্থানীয় এনজিওগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি প্রাপ্তি খুবই অপ্রতুল বলেই আমার মনে হয়। কোনও প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় এনজিওগুলির অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত, এমনকি কোন কোন জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এনজিও নেতৃবৃন্দ অপমানিত পর্যন্ত হয়ে থাকেন। আমি আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারক এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধ করবো, অন্তত ভাসানচরের ক্ষেত্রে প্রকৃত হিরো কারা ছিল সেটা বিবেচনা করা, এই হিরোদেরকে কোনভাবেই ভিলেন বানানো টিক হবে না। আমাদের হিসাব অনুসারে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় অসা অর্থ সহায়তার মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে ব্যয় হয়, অন্যদিকে ২০ শতাংশ ব্যয় হয় আইএনজিওর মাধ্যমে এবং বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয় জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার মাধ্যমে। আমাদের দেশে জাতিসংঘ বেশ কিছু বিশেষ সুযোগ পায়, তাঁদেরকে সবক্ষেত্রে স্থানয়ি এনজিওগুলোর মত এত জবাবদিহিতা করতে হয় না। যদিও নেপাল এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাদেরকে ঠিকই সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। নেপালে তাঁরা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কোনও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে না, তাদেরকে কাজ করতে হয় স্থানীয় এনজিও বা স্থানীয় সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে শুধুমাত্র স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলিকে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অনুমোদন এবং নিরীক্ষা প্রক্রিয়াার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কক্সবাজারে প্রতিটি পয়সা ব্যয়ের ক্ষেত্রে এনজিওগুলিকে আরআরআরসি (শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনার), ডিসি ( জেলা প্রশাসক), ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) এবং সিআইসি (ক্যাম্প ইন চার্জ) এর অনুমোদন এবং নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্থানীয় এনজিওদের পক্ষে এই ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু তারা এর প্রতিটি পর্যায়ে একটি সম্মান আশা করে। পাশাপাশি এই ধরনের জটিলতার কারণে কি দাতা সংস্থাগুলো এনজিও বা আইএনজিওগুলোকে অর্থায়ন না করে, জাতিসংঘকে অর্থায়নের একটি প্রবণতা তৈরি করে কিনা সেটা বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আমরা আহবান জানাই, এবং সবাই জানে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলো তেমন কোন বাধা ছাড়াই অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশে, অথচ তাদের ব্যবস্থাপনা খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
রেজাউল করিম চৌধুরী,
১৪ অক্টোবর ২০২১