ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও হবিগঞ্জের মাধবপুরে মন্দিরে ভাঙচুর ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতিতে হামলার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে হামলা ও ভাঙচুরের জন্য দায়ী করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় আনুমানিক এক হাজার ২০০ ব্যক্তিকে। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সম্প্রীতি সভাসহ নানা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। টহল দিচ্ছে র্যাব ও বিজিবির টিম। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রবিবার আকস্মিক দুটি এলাকার মন্দির ও বসতিতে হামলার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি শান্ত হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক রয়েই গেছে। এসব ঘটনায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কর্মীদের সন্দেহ করা হলেও সংগঠনের পক্ষ থেকে হামলা সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, রবিবার ঘণ্টা দেড়েকের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত নাসিরনগরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সেখানে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেলে প্রশাসনের উদ্যোগে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে নাসিরনগর থানায় দুটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন কাজল জ্যোতি দত্ত ও নির্মল চৌধুরী নামের দুজন ক্ষতিগ্রস্ত। আসামি করা হয়েছে সহস্রাধিক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল করিম জানান, হামলায় অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন আমরা প্রশাসনিক দিক নিয়ে এগোচ্ছি। তদন্ত রিপোর্ট পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রীতি সমাবেশ : মন্দির ভাঙচুর ও সংখ্যালঘু পরিবারে হামলা ঘটনার পর নাসিরনগরে গতকাল বিকেলে উপজেলা প্রশাসন শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে। সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমেদ। সমাবেশে বক্তব্য দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, এনএসআই ডিডি আলমগীর হোসেন, নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার প্রমুখ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা হলে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
এলাকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিপদ পোদ্দার জানান, পরিস্থিতি এখন শান্ত। তবে আতঙ্ক কাটেনি।
নাসিরনগর থানার ওসি আব্দুল কাদের বলেন, থানায় দুটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে হামলাকারীদের অনেকেরই নাম জানা গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে নাসিরনগর ঘুরে দেখা গেছে, মন্দিরগুলোতে ভাঙা প্রতিমা পড়ে আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পূজার সামগ্রী। অনেকের বাড়িতে আসবাব ভেঙে চুরমার। তাদের টাকা, স্বর্ণালংকার লুট হয়েছে বলেও অভিযোগ জানালেন অনেকে। উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া, মহাকালপাড়া, কাশিপাড়া, নমসুদপাড়া, মালিপাড়া ও শীলপাড়ায় প্রায় অভিন্ন চিত্র। হামলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গৌরমন্দির, শিবমন্দির, জগন্নাথমন্দির ও কালীমন্দির। অনেকের বাড়ির ব্যক্তিগত মন্দিরও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত সঞ্জয় গোপ বলেন, ‘হামলাকারীদের হাতে অস্ত্র দেখে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। তারা আমাদের তিনটি ঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে। এলাকার অনেক হিন্দু পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে।’
শিবমন্দিরের সেবায়েত নগেন্দ্র দাস বলেন, হামলাকারীরা মন্দির ভাঙতে উদ্যত হলে তাদের জোড় হাত করি। কিন্তু তারা কথা শোনেনি। মন্দিরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।
এদিকে নাসিরনগরে রবিবার অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজক খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতারা হামলার ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক মুফতি ইসহাক আল হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজনের অন্যায়ের ঘটনায় হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তা নিন্দনীয়। এ ঘটনায় আমাদের নেতাকর্মী জড়িত নয়। পুলিশের উপস্থিতিতে আমাদের সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ।’
এদিকে মন্দির ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, ‘প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই সমাবেশ হয়েছে। অথচ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। প্রশাসনের নির্লিপ্ততার সুযোগেই এ ধরনের হামলা হয়েছে।’
মাধবপুরে ১ মামলা : হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মাধবপুর পৌর এলাকায় ঝুলন মন্দির ও কালীমন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ লোককে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে মাধবপুর থানার এসআই গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। তবে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। মাধবপুর পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। দুপুরে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নজরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত রবিবার নাসিরনগর ও মাধবপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় দুটি স্থানে বেশ কিছু মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
আহলে সুন্নাতের নিন্দা : মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাকে দুঃখজনক অভিহিত করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সমন্বয় কমিটির প্রধান এম এ মতিন বলেছেন, মন্দির ভাঙচুর ঘটনায় জড়িত প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দাবি করছি। অন্যের বাড়িঘরে বা মন্দিরে হামলা করা ইসলাম সমর্থন করে না। এটা করলে পরকালেও শাস্তি পাবে। আহলে সুন্নাতের কোনো কর্মী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় জড়িত নয়। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি এসব কথা বলেন।