সেলিম উদ্দিন :
মফস্বল সাংবাদিকেরা অফিসের একটি ফোন-কলকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। বার্তা সম্পাদক, মফস্বল সম্পাদক, চিফ রিপোর্টার কিংবা সিনিয়র কোনো রিপোর্টার কল করেন বিভিন্ন সময়ে। সুনির্দিষ্ট ইস্যু ধরিয়ে নিউজ করে পাঠাতে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এসাইনমেন্ট পেয়ে দিনভর চলতে থাকে ছুটোছুটি। কলুর বলদের মতো খেটেখুটে সন্ধ্যা নাগাদ কষ্টের বানানো রিপোর্ট পৌঁছে যায় অর্ডারদাতার মেইলে। পত্রিকাটির প্রধান কার্যালয় থেকে কল করেছেন বড় সাংবাদিক। হেড হেড ভাব নিয়ে ধমকের সুরে এসাইনমেন্ট। ঠিক সময়ে রিপোর্ট জমা না দিলে যদি বেচারার সাংবাদিকতা যদি চলে যায়!
মফস্বলের সাংবাদিক এটাও ভাবেন যে, প্রথম পাতায় কোনদিন রিপোর্ট ছাপা হয়নি। হেড অফিসের বড় সাংবাদিকের কল্যাণে এবার বুঝি ফ্রন্ট পেজে নিউজ পাচ্ছি। অনেকদিনের জমানো আক্ষেপটাও বুঝি ঘুচলো! এইসব চিন্তা ভাবনা করেন আর দিনভর পরিশ্রম করে রিপোর্ট পাঠান সবজান্তা সমশেরের কাছে।
রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েই টেনশন শেষ না। নতুন অপেক্ষা নিউজটি ছাপা হলো কি-না, কোন পেজে হলো- এসব নিয়ে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন পত্রিকায় নিউজ দেখার জন্য। যেন নিজের প্রথম সন্তানের মুখ দেখবেন! গিন্নি ঘুমাতে বললেও চোখে ঘুম আসেনা। অনেকদিন পর বোধহয় প্রথম পাতায় রিপোর্ট ছাপা হবে। এই উত্তেজনা কি তাঁর কোন দিক থেকে কম?
তাই মোবাইল আর ল্যাপটপে রাত জেগে অনলাইনে খুঁজে বেড়ান কাঙ্খিত রিপোর্ট। ওইদিনের রাতটি যেন অন্য দিনের চেয়ে একটু দীর্ঘতর হয়ে যায়। বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত দুইটা কিংবা আড়াইটা নাগাদ রিপোর্টের শিরোনাম দেখে খুশিতে মনটা ভরে ওঠে। বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করতেই যেন চোখ ছানাবড়া! সব কষ্ট বুঝি জলেই গেলো! রিপোর্টে নাম ছাপা হয়েছে একটি। সেই বড় সাংবাদিকের! আবারও ক্ষণিকের আশা জেগে ওঠে। বোধহয় নিচের দিকে আমার নামটি দিলো। নিচে নামতে শুরু করেন। না। রিপোর্টের মাঝখানে কোথাও নেই। নেই একদম শেষেও!
এত ঘাম ঝরানো তথ্য জোগাড় কিংবা কষ্টে লেখা রিপোর্টটি হয়ে গেলো বড় সাংবাদিকের কৃতিত্ব! মফস্বল শহরের সাংবাদিক নামের ওই শ্রমিকের কোন ক্রেডিটও দেয়া হয়নি। নিউজ দেখে রাজ্যের হতাশা আর এক বুক কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মফস্বলের সাংবাদিক।
চোখে ঘুম আসেনা। আসবেই বা কী করে! সব কষ্ট যে চুরি হয়ে গেলো! মনে মনে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেন- সাংবাদিকতার গুষ্ঠি মারি। আর লিখবো না। তার ওপরও কষ্টও চুরি হয়ে যায়। এমন সাংবাদিকতা না করলে কি হবে! সকাল হলেই অব্যাহতিপত্র পাঠিয়ে দিবেন। রাগে যেন শরীর কাঁপতে থাকে।
সকাল হয় ঠিকই। অব্যাহতিপত্র আর লেখা হয় না। রাতের আঁধার কাটতেই সবকিছু বেমালুম ভুলে যান মফস্বল সাংবাদিক। মনে মনে ভাবেন, কই কিছুই তো হয়নি। ছুটে চলেন নতুন আশা বুকে নিয়ে। নতুন উদ্যোমে শুরু হয় আবারও কর্মচঞ্চলতা। অথচ তখন অফিস ঘুরে ঘুরে কৃতিত্ব নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ান সেই বিখ্যাত বড় সাংবাদিক। সারা অফিস ঘুরে ঘুরে জাহির করেন আর সুযোগ বুঝে তেল মেরে কয়েক ধাপের প্রমোশনও বাগিয়ে নেন। নৈতিকতা বুলি আওড়িয়ে তিনি বনে যান অনেক কিছু। কিন্তু কী করে ভুলে থাকেন, অন্যের কষ্ট চুরি করে বড় সাংবাদিক হওয়া যায়, মানুষ হওয়া যায়না?
নোট: ‘বড় সাংবাদিক’ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
লেখক: সেলিম উদ্দিন, সম্পাদক ও প্রকাশক- সাপ্তাহিক আলোকিত ঈদগাঁও (প্রস্তাবিত)।