মিতুল ও সাব্বির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে এখন পর্যন্ত তাদের গলায় গলায় ভাব। মাত্র ক্লাস নাইনে উঠলো তারা। চোখে রঙিন চশমা। পৃথিবীর সবকিছুই রঙিন রঙিন লাগে। মিতুল বরাবরই মেধাবী ছাত্র। শ্রমিক বাবার একমাত্র আশার আলো। সংসারী মাও সংসারের কাজকর্মের ভিতরই মিতুলকে আগলে রাখেন। সংসারের এত অভাব-অনটন কিছুই বুঝতে দেয়না মিতুলকে। বন্ধু সাব্বির বড়লোক বাবার পুত্রধন। মিতুলের বন্ধু হবার সুবাদে এতদিন ধরে ঠিকমত পড়াশুনো না করলেও ঠিকই টেনেটুনে পরীক্ষায় পাশ করে এসেছে কিন্তু দিনদিন অধঃপতনে পা বাড়ানো তার রীতিতে পরিণত হয়েগেছে। ক্লাস সিক্স থেকেই সিগারেট ফুঁকছে। মাঝেমাঝে মিতুলকেও জোর করে খাওয়ায় কিন্তু এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে মিতুল। কারণ শত ব্যস্ততায়ও মা ঠিকই মিতুলের সবকিছু গুছিয়ে দেয়। বইপত্র, ব্যাগ নিয়মিত চেক করে। তাছাড়া মা-বাবাকে ভীষণ ভয় পায় কারণ মা-বাবাকে যে বড় ভালোবাসে সে। তাই এইসব থেকে একশো মাইল দূরে থাকে মিতুল। কিন্তু ক্লাস নাইনের উঠার পর নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হচ্ছে মিতুলের। মা-বাবার এত নজরদারি তার ভাল লাগে না। সংগ দোষে লোহা ভাসে। মিতুলের ইদানীং সাব্বিরের সান্নিধ্য খুব ভালো লাগে। সাব্বির তাকে নতুন এক মাদকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যা সস্তা কিন্তু সেবনে অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে।
এবার মূল প্রসঙ্গে চলে আসি। বিভিন্ন ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেশা করছে কিছু সংখ্যক মানুষ যারা যে কোন বয়সের হতে পারে। বিভিন্ন এলাকার কোমলমতি শিশু কিশোরদের কাছে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে ঘুমের ট্যাবলেট ও কাশির সিরাপ।
স্থায়ীভাবে এটি মিক্সচার বা ফিটনি নামে পরিচিত। মিতুল একজন কিশোরের ছদ্মনাম। ফিটনি সেবনকারী মিতুলের ভাষ্যমতে, এলাকায় কিছু কিশোররা ফ্যানারড্রিল, অফকফ, তুসকা, ডেক্সপোটেন, এক্সপোটেনসহ আরো অনেক কাশির সিরাপের মধ্যে ইজিয়াম, ডিজিপন-২, ওরাডেক্সন, ইজিতেন গুঁড়ো করে সিরাপের মধ্যে ঝাঁকিয়ে সেবন করে। এটি সেবনের কিছুক্ষণ পরে নেশায় চোখ লাল হয়ে যায়। তাদের কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যায়। মনেহয় তারা যেন এক রঙিন ভুবনে বিচরণ করছে। অসংলগ্নভাবে বিড়বিড় করে কথা বলে যা নিজেদের মধ্যেই বোধগম্য নয়।
মিতুল আরো জানায়, বিভিন্ন এলাকায় কিছু যুবক ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এসব ঔষধ কিনে এনে উঠতি বয়সের কিশোর/সেবনকারীদের কাছে সরবরাহ করে থাকে।
এখন আমরা জানতে চেষ্টা করবো, মাদকের নতুন নাম মিক্সচার বা ফিটনি কি এবং এ কার্যক্রিয়া সম্বন্ধে।
বাজারে কাশির সিরাপের মধ্যে রয়েছে ডেক্সপোর্টেন, অফকফ, এনকফ, সুডোকফ, তুসকা, ডিক্সার, এ কফ, ফেনাড্রিল ইত্যাদি। এই সিরাপে আছে – সিউডোফিড্রিন, ডেক্সট্ররমিথোফরমিন এবং ট্রাইমিথোপ্রলিপ্রিন। এটা খাবার পর রক্তচাপ বেড়ে যায়, ঝিমুনি আসে, ইউফোরিয়া সৃষ্টি হয় এবং শেষে ঘুমিয়ে পরে আসক্ত ব্যক্তি। ফেন্সিডিল মূলত একটি কফ সিরাপ। এটি তৈরী হয় কোডিন ফসফেট, ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড, প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড এই তিনটি উপাদানে সমন্বয়ে। কোডিন ফসফেট হচ্ছে মরফিন এর একটি ডেরিভেটিভ এতে প্রায় ৫% মরফিন থাকে। এটি গ্রহণ করার আধাঘন্টার মধ্যে শরীরে মরফিন তৈরী হয়। আর মরফিন এর কাজ হলো আমাদের স্নায়ূ ও মাংশপেশীকে শিথিল করে দেয়া। ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড এর কাজ হলো শ্বাসনালীর শ্লেষ্মাকে শুকিয়ে দেয়া। প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড সিডেটিভ হিসাবে কাজ করে। ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড শ্বাসনালীর শ্লেষ্মাকে শুকিয়ে দেয়, প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড অনেকটা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে আসে।
শ্বাসনালী সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে আসে এবং মুখ শুকিয়ে আসে, শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মে শরীর ঠান্ডা করতে গিয়ে প্রচুর ঘাম বের হতে থাকে। অবচেতন মন ভালো মন্দ সব ভাবনার শৃঙ্খলকে করে অবমুক্ত। নেশাকারী ঘুড়ে বেড়ায় এক সাময়িক মানসিক আনন্দের রাজ্যে, যার উপসংহার শুধুই ধ্বংশ।
শ্রমিক বাবার একমাত্র স্বপ্ন, আশার আলো ছেলেটি (মিতুল) অসৎ সঙ্গে থেকে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। ফিটনি সেবনকারী বন্ধুদের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি বা মতানৈক্য দেখা দিলে নেশাগ্রস্থ কিছু যুবকের ছুড়ির আঘাতে প্রাণ হারায় মিতুলের বন্ধু সাব্বির। আর সেই অপমৃত্যুর জন্য দায়ীদের মধ্যে মিতুলের নামটিও থাকে। তখনই মিতুল নামের একটি মেধাবীর মৃত্যু ঘটলো চিরতরে।
লোকমুখে শোনা যায়, এদেশের হাজারো মেধাবী যারা বুদ্ধিতে, শিক্ষা-দীক্ষায় সবার চেয়ে সেরা তাদেরই একাংশ এজাতীয় নেশায় আসক্ত এমনকি ‘ইয়াবা’ নামক ক্লান্তিহীন মাদকটি সেবন করে, ক্লান্তিহীনভাবে পড়াশুনো করার হাতিয়ার হিসেবে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির বক্তব্য, ঢাকার বসুন্ধরার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষার্থীরা নাকি বিকেলের পর অলিতে গলিতে বসে বসে ইয়াবা ফেন্সিডিলসহ নানান মাদক গ্রহণ করে ওপেনলি। যারা ওখানকার বাসিন্দা তারা এসব দেখতে দেখতে চোখসয়া হয়ে গেছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ব্যক্তির ভাষ্যমতে, মা-বাবা কত আশাকরে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়াচ্ছেন কিন্তু এখানকার অধিকাংশ ছেলেমেয়েরায় এসব মাদকসেবনকে কমন ফ্যাশনে পরিণত করেছে। গুটিকয়েক হয়তো ব্যতিক্রম।
বর্তমানে বাংলাদেশকে মাদকের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে পারাটাই হবে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামক মানচিত্রটি মাদক নামক কলংকের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য। চোখের সামনে একটার পর একটা মিতুলের ধ্বংশ দেখা ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই থাকবে না!
মাদকের নতুন আতংক এই
সহজলভ্য, স্বল্পদামী মিক্সচার বা ফিটনি’র সর্বগ্রাসী থেকে আমাদের প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
তাছাড়া ফার্মেসী মালিকদের সতর্ক করে দেয়া, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া তারা যেন এজাতীয় কোন ঔষধ বিক্রি না করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ আরো বলেন, এসব ঔষধ দীর্ঘদিন সেবনের ফলে লিভার ও কিডনী নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা চাইলে, এসকল মাদকের ব্যবহার রোধ করতে পারে বলে আমি মনে করি। শুধু প্রয়োজন ব্যক্তিগত সতর্কতা।
লেখক : মাহবুবা সুলতানা শিউলি
সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ইমেইল : [email protected]