উখিয়া নিউজ ডেস্ক;;
তিন হাজারেরও বেশি মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এতে সারাদেশে মাদক ব্যবসায় জড়িত গডফাদার, ডিলার ও ব্যবসায়ীদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। তাদের সহায়তাকারী হিসেবে দেড় শতাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পুলিশ সদস্যের নামও তালিকায় এসেছে। গত বছরের শেষদিকে তালিকাটি প্রস্তুত করা হলেও চলতি বছরের শুরুতে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। তালিকায় থাকা মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের সহায়তাকারীরা এখনও রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে ডিএনসির অপারেশন ও গোয়েন্দা শাখার পরিচালক ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি সমকালকে জানিয়েছেন, তালিকা ধরে গ্রেফতার অভিযান চালানো হচ্ছে। সব মাদক ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা হবে।
গত শুক্রবার পুরান ঢাকার ধুপখোলা মাঠে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, মাদক চোরাচালান বা ব্যবসার সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবির কিছু অসাধু সদস্য জড়িত, তা অস্বীকার করব না। প্রমাণ পেলে বাহিনী থেকে তাদের চাকরিচ্যুত করে আইনের আওতায় আনা হবে। ডিএনসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, তিন ক্যাটাগরিতে সারাদেশের প্রায় তিন হাজার ১০০ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় ডিলার রয়েছে ৭০০ ও গডফাদার প্রায় দেড়শ’। গডফাদারদের মধ্যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরও নাম রয়েছে। তালিকায় তাদের স্বজনদেরও নাম রয়েছে। তারা মূলত আড়ালে থেকে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে ডিএনসির কর্মকর্তারা সহজে তাদের ধরতে পারেন না। ওই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে ট্রলারে করে ৩৫ লাখ ইয়াবার চালান আসে। ওই চালানটি ছিল চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির। উপকূলে মাঝিদের কয়েকটি ট্রলার দেখে তা কোস্টগার্ড সদস্যের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। এক পর্যায়ে পাচারকারীরা ইয়াবাভর্তি ট্রলার পানিতে ডুবিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর জেলেদের অনেকেই ডুব দিয়ে কয়েক লাখ ইয়াবা পানি থেকে তুলে নিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, তালিকায় ইয়াবার গডফাদার হিসেবে কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ-উখিয়া) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুুর রহমান বদির ভাই আবদুুস শুক্কুর, আবদুুল আমিন, ভাগিনা শাহেদুর রহমান নিপু, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, শাহজাহান ও দিদার আহমদের নাম রয়েছে। সহায়তাকারী হিসেবে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অন্তত ১৫ পুলিশ সদস্যের নামও রয়েছে। এর মধ্যে এসআই আলমগীর, সরোজ আচার্য, এএসআই আযহার ও আমিরুল রয়েছেন। তারা এরই মধ্যে বদলি হয়ে গেছেন। তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ টেলিফোনে বলেন, ‘আমি ও আমার ছেলেরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নই। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো থানায় মামলাও নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমি জনপ্রতিনিধিত্ব করছি। আমি মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কারা কীভাবে তালিকায় আমাদের নাম দিল তা বুঝতে পারছি না।’
এ ছাড়া পঞ্চগড়ের অমরখানা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুজ্জামান, বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিলন, তেঁতুলিয়ার ভজনপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মোস্তফা কামাল পাশা, সাইদুর রহমান বাবলু ও শ্রমিক দল নেতা মুক্তারুল ইসলাম মুকুসহ আরও ৩৮ জনের নাম গডফাদারের তালিকায় রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন ২১ জন পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। এর মধ্যে এসআই ফিরোজ, এসআই মোজাম্মেল, এএসআই মাসুম বিল্লাহ, কনস্টেবল মোক্তার হোসেন, নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন প্রমুখ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এরই মধ্যে বদলি হয়ে গেছেন।
তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান মিলন সমকালকে বলেন, ‘নেশা তো দূরের কথা, আমি সুপারি পর্যন্ত খাই না। আমি মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছি। প্রতিপক্ষ কেউ হয়তো আমাকে হেয় করার জন্য তালিকায় নাম উঠিয়েছে।’
এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল পাশা। টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘কে বলেছে আমার নাম আছে, আমি ১৮ বছর ধরে জনপ্রতিনিধিত্ব করছি। আমার নাম তালিকায় আছে, এমন কথা বলার সাহস আপনি কোথায় পেয়েছেন ? আমার সামনে আসেন।’
যশোরে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে ২৯ জনের নাম। তার মধ্যে বেনাপোলের বাদশা, সেলিম, আসমা খাতুন, মোহাম্মদ আলী, আলিমুর, বাবু, মুকুল, কোরবা, শরিফুল; শার্শার অশোক, নূহু, আয়েব আলী ও তোফাজ্জেল। তারা ভারত থেকে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য শার্শা থানার রুদ্রপুর, অগ্রভুলোট, গোগা ও বাগআঁচড়ার ভেতর দিয়ে নাভারন বাজার হয়ে অথবা ঝিকরগাছা হয়ে যশোর শহরে আনে। অন্যদিকে বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর, গাতিপাড়া, সাদীপুর, রঘুনাথপুর থেকে শার্শা-নাভারনের ভেতর দিয়েও যশোরে মাদকদ্রব্য আনা হয়। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের রেজাউল পাঠান, কালীগঞ্জের লিটন চেয়ারম্যান, মিথুন মালিথা, মহেশপুরের জিয়াউদ্দিন জিয়া, আনোয়ার হোসেন, রমজান আলী ও আবদুুল মান্নানের নাম রয়েছে গডফাদারের তালিকায়। ফেনীর রয়েছে ৮১ জন। তার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতা আজাদ হোসেন, বিএনপির সাবেক (সংরক্ষিত আসন) এমপি রেহানা আক্তার রানুর ভাইয়ের ছেলে ইসমাইল হোসেন, জেলা যুবলীগ নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার, আওয়ামী লীগ নেতা কমিশনার গিটার, ধর্মপুর ইউপি আওয়ামী লীগ নেতা সোহাগ, ফুলগাজী থানা বিএনপি নেতা আবদুর রউফ ও তাজুল ইসলাম। রাজশাহীতে গডফাদারের তালিকায় রয়েছে গোদাগাড়ীর শীশ মোহাম্মদ, আলমগীর ডাবলু, নয়ন, রাজপাড়ার স্বপন; পবার জাহাঙ্গীর আলম, বোয়ালিয়ার সাগরসহ বেশ ক’জনের নাম। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের লাবু, হাবু, জামিল হোসেন, আলতাফ হোসেনসহ ১০ জনের নাম তালিকায় আছে। গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের আমজাদ সরকার, রমজান আলী, হোসনা বেগম, মধু, আবুল হোসেন, লিটন হোসেন, সোহেল রানা, পারভীন আক্তার; শ্রীপুরের সালমা, পারভেজ, রাশিদা, ফারুক, খুরশিদা খাতুন; কালিয়াকৈরের আবদুল মান্নান, কর্ণমোহন বর্মন, সোহেল রানা; কাপাসিয়ার কামিনী রবিদাস, আরতী রবিদাস; টঙ্গীর নুর আলম ওরফে দুদু মিয়া, শাহনাজ, লাইলী বেগম, আসিয়া খাতুন, রিনা খান, বাগু মিয়া, স্বপনার মিয়া, ফাতেমা, বাচ্চু মিয়াসহ অনেকের নাম মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে।
রাজধানীর অন্তত ৩০০ মাদক ব্যবসায়ী ও নিয়ন্ত্রকের নাম এসেছে। এ ছাড়া খুচরা বিক্রেতাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। মহাখালী, বারিধারা ও গুলশানে ইয়াবার বড় ব্যবসায়ী মাসুদ। তার নেতৃত্বে এসব এলাকায় ইয়াবা বেচাকেনা হচ্ছে। পুরান ঢাকার মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে নাম আছে রন্টির। ভাটারা নতুন বাজারের আনোয়ারা বেগম ওরফে আনু, তুরাগের রেজাউলসহ আরও ৩০০ জনের নাম রয়েছে। কক্সবাজার থেকে যারা ইয়াবা ঢাকায় এনে সরবরাহ করে তাদের মধ্যে রয়েছে উখিয়ার পলাশ বড়ূয়া, টেকনাফের তৈয়ব, আইয়ুব, ইলিয়াস, রেজাউল করিম, এনামুল হক, শাহাব উদ্দিন শাপু; কক্সবাজার সদরের রমজান আলী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কুতুব উদ্দিন রনি।
জানা যায়, রাজধানীতে চার শতাধিক স্পটে মাদক ব্যবসা চলছে। সংশ্লিষ্টরা অনেককে ম্যানেজ করে চিহ্নিত ওইসব স্পটে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে- তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার রেল বস্তি, দিলু রোডের পশ্চিম মাথা, মালিবাগ রেলক্রসিং, যাত্রাবাড়ী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আনন্দবাজার বস্তি, ওসমানী উদ্যান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশ এলাকা, কাঁটাবন, মোহাম্মপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর, শেরেবাংলানগর, কড়াইল বস্তি, সাততলা বস্তি, আজিমপুর কবরস্থানের আশপাশ এলাকা, আজিমপুর মেটার্নিটি হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকা, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে, বাবুবাজার ব্রিজের ঢাল, আরমানিটোলা স্কুলের আশপাশ ও কামরাঙ্গীরচর।
একটি সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডিএনসিকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সালাহউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি সারাদেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে ত্রৈমাসিক বৈঠকে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেন। সুত্র: দৈনিক সমকাল
পাঠকের মতামত