রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
সম্প্রতি মানবিক কর্মসূচিতে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা কর্মসূচিতে, বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়ে সম্পর্কে আমাদের অবস্থান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আমরা এই বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাই; আমরা ত্রাণ কর্মসূচিতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিপক্ষে নই, অনেক উন্মুক্ত আলোচনায় আমরা বলেছি যে, এখানে বিদেশিরা কেবল অর্থ নিয়ে আসে না, তারা কিছু ব্যতিক্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে এখানে আসে, এসব জ্ঞান এবং দক্ষতা আমাদের এনজিও / সিএসওগুলির অর্জন করা প্রয়োজন। আমরা কক্সবাজারের প্রায় ৩০০ ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম, যেখানে কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার বিদেশি প্রধানগণ অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের ছাত্রছাত্রীগণ বিদেশি এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে তাঁদের পেশাগত উৎকর্ষ, তাঁদের দেশ- সংস্কৃতি এবং জীবন সংগ্রাম সম্বন্ধে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে।
তবে, আমরা রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সক্ষমতা বিকাশ সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে চাই। বাংলাদেশে এবং কক্সবাজারে প্রযুক্তি ও দক্ষতা হস্তান্তরের বিষয়ে পরিকল্পিত কোন উদ্যোগ দেখাই যাচ্ছে না। বিদেশি কর্মীরা চলে গেলেও স্থানীয়রা যেন সংকট মোকাবেলার কাজগুলো সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে জন্য এই জ্ঞান ও দক্ষতা হস্তান্তর প্রয়োজন।
দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয়টি হলো পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা খরচ, কারণ অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। গত দুই বছরে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, জাতিসংঘের এজেন্সিগুলি মোট চাহিদার প্রায় ৬০% থেকে ৭০% অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। আর বর্তমান বছরে এখন পর্যন্ত অর্থ সংগ্রহের হার চাহিদার মাত্র প্রায় ২৫% থেকে ৩০% এর কাছাকাছি। এটি নিশ্চিত যে উন্নত দেশগুলো করোনা সঙ্কটের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হবে, অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁদের মানবিক সহায়তার পরিমাণ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে , আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সহজে স্থানান্তর এবং স্থাপনযোগ্য দ্বিতল আশ্রয়স্থল, আয়- বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম এবং উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলছি, এসবের জন্য আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন। আর এসব দিক বিবেচনা করেই, আমরা বিদেশিদের নিয়োগ কমিয়ে এনে ব্যয় হ্রাস করার নীতি গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমরা মনে করছি।
আমরা বিশ্বাস করি না যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতে বিদেশি কর্মীদের বদলে এদেশীয় কর্মীদের নিয়োগ দিলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শুরু থেকেই আমরা বলে এসেছি যে, জাতিসংঘের সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে মূলত মনিটরিং/ পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ, এবং মাঠ পর্যায়ের সমস্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকতে হবে স্থানীয় এবং জাতীয় এনজিও এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ( কক্সবাজারের স্থানীয় এনজিওগুলোকে এক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে)। কেবল ব্যয় হ্রাস করার জন্যই নয়, ভবিষ্যতের স্থায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে, মানবাধিকার / শরণার্থী অধিকারের স্বপক্ষে ক্রিয়াশীল একটি সমাজ গঠনে উপযুক্ত স্থানীয়দের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা উচিৎ।
উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের সংস্থাগুলিসহ সব সংস্থা এবং দেশগুলো কর্মী নিয়োগে সাহায্য গ্রহীতা দেশগুলোর সর্বোচ্চ অধিকারের বিষয়টি মেনে নেয়। এই চেতনাটি উন্নয়ন সহযোগিতা এবং কার্যকর উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনা, বিশেষ করে গ্র্যান্ড বারগেন আলোচনায় স্বীকৃত। জাতিসংঘ এই প্রতিশ্রুতিগুলির সূচনাকারী। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, বেশিরভাগ বিদেশি কর্মী নিয়োগ হচ্ছে দেশগুলোর চাহিদার নিরিখে নয়, বরং দাতা/জাতিসংঘ সংস্থা/আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সরবরাহ করার আগ্রহ থেকেই! আমরা এটি স্বীকার করি যে, কিছু সময় দাতাসংস্থাসমূহ গুণগত মান বজায় রাখতে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন তদারকি করার জন্য নিজস্ব লোকজনদেরকে নিয়োগ দিতে শর্ত দিয়ে থাকে। তবে এটি নিয়মিত বা দীর্ঘমেয়াদী হওয়া উচিত নয়। সরকার, জাতিসংঘের এজেন্সিগুলি, বেসরকারি সংস্থাগুলির নীতিনির্ধারকদেরকে বিদেশি কর্মীদের প্রকৃত চাহিদা যাচাই করে দেখা উচিৎ, বিশেষ করে প্রকৃতপক্ষে কোন প্রযুক্তি এবং দক্ষতা স্থানান্তরের প্রয়োজন রয়েছে কিনা বিবেচনা করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদে একটি দেশ বা একটি সম্প্রদায় কেবল বিদেশিদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে থাকতে পারে না। কিভাবে স্থানীয় জ্ঞানকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায় দাতা সংস্থা , জাতিসংঘের সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর নীতিনির্ধারকদের সেটাও বিবেচনা করা উচিত। দক্ষতার উন্নয়ন বা বিকাশের পরিবর্তে আমাদেরকে ‘দক্ষতা বা সক্ষমতার সমন্বয়’ বিবেচনা করতে হবে, কারণ স্থানীয়দেরও স্থানীয়ভাবে কাজ করার সহজাত কিছু জ্ঞান ও দক্ষতা আছে, যা সাহায্য প্রদানকারী সংস্থাগুলোর জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রায়শই উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে।
রেজাউল করিম চৌধুরী
পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট।