থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়ায় একবার পা দিতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। মাসে লাখ টাকা উপার্জন। দেশে পরিবারের অভাব ঘুচবে। কয়েক বছর কাটাতে পারলেই মিলবে বৈধতা। ঘুরবে ভাগ্যের চাকা। যেতে লাগবে না খুব বেশি টাকা। সেখানে পৌঁছেও থাকবে বকেয়া পরিশোধের সুযোগ। এভাবেই সাগরপথে অবৈধভাবে বিদেশ পাঠাতে অন্তত ৫০০ দালাল সক্রিয়। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। সাগরে সলিলসমাধি ঘটেছে হাজারো তরুণের স্বপ্ন। এর পরও থেমে নেই মানব পাচার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কাজে জড়িত অন্তত ৫০০ দালালকে তারা চিহ্নিত করেছে। এদের অবস্থান দেশের ১৮টি জেলায়। দালালরা ভালো চাকরি ও কম টাকায় বিদেশ পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে লোক সংগ্রহ করে। এখন তারা রোহিঙ্গাদের পাঠাতে তৎপর। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে টেকনাফের বাহারছড়া উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরে এমনই রোহিঙ্গাবাহী একটি ট্রলার ডুবে তিন নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় কোস্টগার্ডের সদস্যরা চার বাংলাদেশি দালালসহ ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন। এখনও নিখোঁজ অন্তত ৩০ জন। এ দুর্ঘটনার পর গতকাল থেকেই মানব পাচারকারীদের ধরতে জেলায় বিশেষ অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে যাত্রীদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দালালরা। সারাদেশে এদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। তাদের ধরতে জেলায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। মানব পাচার ঠেকাতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পুলিশ, কোস্টগার্ড ও উদ্ধার রোহিঙ্গারা জানান, অবৈধভাবে ট্রলারে করে সোমবার গভীর রাতে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয় অন্তত ৭০ রোহিঙ্গা। সেখানে তাদের ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে দালালচক্র মাথাপিছু ২০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও বাহারছড়া উপকূল দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ মালয়েশিয়া যাচ্ছে। এখানে দালালচক্রের নেতৃত্বে আছে শাহপরীর দ্বীপের ধলু হোসেন ও শরীফ হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে। তবে ধলু ও শরীফ সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
থানায় বিভিন্ন সময় করা মানব পাচার মামলা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দালাল হিসেবে টেকনাফের সাবরাং এলাকার আকতার কামাল, সাঈদ কামাল, মোয়াজ্জেম হোসেন; রামুর কালিমারছড়ার মোহাম্মদ হোসেন, শাহপরীর দ্বীপ মাঝরপাড়ার জায়েত উল্লাহ, সব্বির আহাম্মদ, সাজেদা বেগম, আব্দুল্লাহ, ইউনুচ, কলিম উল্লাহ, আব্দুস শুক্কুর, ঘোলাপাড়ার শামসুল আলম, কবির আহমদ, হাজীপাড়ার মুজিব উল্লাহসহ অন্তত ২৫০ জনের নাম এসেছে।
টেকনাফের বাইরে দালাল হিসেবে পুলিশ চিহ্নিত করেছে নরসিংদীর মো. শাহজালাল, নুর মোহাম্মদ প্রকাশ ইমরান, জিয়াউর রহমান, আবদুর রহমান; নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলাম, শহিদ উল্লাহ, আবদুস সাত্তার; চুয়াডাঙ্গার মো. আকিম, মো. কাশেম, আকিল উদ্দিন; সিরাজগঞ্জের সাত্তার মোল্লা, কুড়িগ্রামের মো. সালাম, সাতক্ষীরার আশরাফ মিয়া, বগুড়ার সাহাব উদ্দিন, যশোরের আবুল কালাম, মেহেরপুরের আহাম্মদ উল্লাসহ অন্তত ৩০০ জনকে।
টেকনাফ মডেল থানা সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১২৫টি মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ৯ মাসে শুধু টেকনাফ উপকূল থেকেই ২০ দালালকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিভিন্ন সময় উদ্ধার অভিবাসনপ্রত্যাশী, পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, দালালচক্র সাগরপথে বাহারছড়া ও শাহপরীর দ্বীপকে মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এসব এলাকা দিয়ে গত এক বছরে সহস্রাধিক মানুষ মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকশ' জনের হদিস মেলেনি। আগে টেকনাফসহ কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ মালয়েশিয়া গেলেও এখন এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, নাটোর, বরিশাল, ভোলা, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, যশোর ও রাজশাহী। এসব জেলায় দালালদের শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, গত তিন বছরে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ট্রলারডুবির ঘটনায় তিন শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। এর বাইরে পাচারের সময় আটক হাজারো মানুষ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভারতের কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে। এর পরও থেমে নেই অবৈধভাবে বিদেশ গমন। মানব পাচার ঠেকাতে হলে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সুত্র: সমকাল