সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে ক্রমাগত পিছু হটা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের আরো একটি বড় পরাজয় ঘটেছে। এবার দেশটির স্থল বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর মায়াবতী দখলে নিয়েছে বিদ্রোহী কারেন জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র যোদ্ধারা।
সেখানে জান্তা সরকারের বহু সংখ্যক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে তিন বছর আগে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা আরেকটি বড় পরাজয়ের সম্মুখীন হলো বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের ও মিয়ানমারের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের সিংহভাগই হয়ে থাকে এই মায়াবতীর শহরের মাধ্যমে।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে, মায়াবতী থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমের থাঙ্গানিনাং শহরে অবস্থান নেয়া জান্তা সরকারের এক ব্যাটালিয়ন (৫০০ থেকে ১৫০০) সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।
জাতিগত কারেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সহায়তা পাচ্ছে। আর তাদের প্রবল যুদ্ধের সামনে একরকম অসহায় হয়ে পড়ে মিয়ানমারের সেনারা। অবশেষে বিরাট সেনাদল নিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে যায়।
মায়াবতী দখলের পর যোদ্ধাদের একটি উচ্ছ্বসিত ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে, যেখানে দখলে নেয়া বিরাট অস্ত্রাগার দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছরের মাথায় জান্তা সরকার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
বিদ্রোহীদের আক্রমণে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বিজিপিসহ সরকারি সব বাহিনী কোণঠাসা। এমন অবস্থায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দ্রুত হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী।
স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার-এর তথ্য অনুযায়ী, জান্তা সরকারের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে দেশটির মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের ওপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে চলে গেছে ৫২ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড।
সেখানে সামরিক বাহিনী প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং তারা দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অবস্থায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দ্রুত হারাচ্ছে জান্তা সরকার।
জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এরি মধ্যে মিয়ানমারের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। বহু সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে এবং অনেকেই জান্তা সরকারকে পরিত্যাগ করে বিরোধীদের দলে যোগ দিয়েছে।
আর জান্তা সরকার সৈন্য ঘাটতি কমাতে এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই জোরদার করতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
মায়াবতী দখলের বিষয়ে বিবিসি লিখেছে, থ্যাইল্যান্ড সীমান্তের শহরটি বিদ্রোহীদের দখলে যারা সামরিক জান্তার জন্য একটি গুরুতর ধাক্কা। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্য এবং বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে রাখাইন রাজ্যের বিশাল এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়েছে জান্তা বাহিনী।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে জাতিগত কারেন জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন।
১৯৯০-এর দশকে সরকারি বাহিনীর ব্যাপক অভিযানে টিকতে না পেরে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে কারেন যোদ্ধারা এবং ২০১৫ সালে একটি জাতীয় যুদ্ধবিরতিতে চলে যায় তারা।
মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারের সময় কারেনরা কিছুটা চুপচাপ থাকলেও পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০২১ সালে সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর।
জান্তা সরকার জোরপূর্বক আবার ক্ষমতায় এলে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ঘোষণা দেয় যে, অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার ফলে তাদের যুদ্ধবিরতিও বাতিল হয়ে গেছে।
এরপরই অন্যান্য জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জান্তা সরকার উৎখাতে সশস্ত্র প্রতিরোধে নামে কারেন যোদ্ধারা।
গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর ছাড়াও দেশটির সবচেয়ে বড় নগর ইয়াঙ্গুনেরও তুলনামূলক কাছাকাছি অবস্থান মায়াবতীর। আর তিন বছর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিক্ষোভ দমনে নৃশংসতার ফলে ভিন্নমতাবলম্বী বহু মানুষ তখন পালিয়ে মায়াবতীতে আশ্রয় নেয়।
আর এই সুযোগেই কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন নিজেদের যোদ্ধা জোগাড়ের পাশাপাশি, অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করে।
কারেন রাজ্যের উত্তরে কারেননি ন্যাশনালিটিস ডিফেন্স ফোর্স এবং দেশের একদম উত্তরে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির মতো অন্যান্য বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সাথে সমন্বয় করে অপারেশন চালাচ্ছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন