নিউজ ডেস্ক::
মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযানে গতকাল রবিবার পর্যন্ত এক হাজারের বেশি আটক হওয়ার খবর দিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিকই বাংলাদেশি শ্রমিক।
অবৈধ শ্রমিকদের সাময়িক বৈধতা হিসেবে এনফোর্সমেন্ট কার্ড (ই-কার্ড) করার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়া। গত শুক্রবার ৩০ জুন মধ্যরাতে ই-কার্ড করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ধরপাকড় অভিযান শুরু করে দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের দিয়ে যারা কাজ করাচ্ছিল সেসব প্রতিষ্ঠানের ১৬ জন মালিককেও আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ। তাঁদেরকে বিপুল পরিমাণ জরিমানাও করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় প্রায় আট লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছে। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ শ্রমিক অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
আটক অভিযান শুরু হওয়ায় বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। অনেকে আটক হওয়া থেকে বাঁচতে বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে। এতে দেশে থাকা তাদের স্বজনরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। স্বজনরা মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের ফোন করে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আতঙ্ক ভর করেছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যেও। যেসব প্রতিষ্ঠানে অবৈধ শ্রমিক কাজ করে তাদের মালিকরা এখন অবৈধ শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অবৈধ শ্রমিকদের কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ছয় লাখেরও বেশি শ্রমিক অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ।
অবৈধ শ্রমিকদের আটক অভিযান সম্পর্কে জানতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ই-কার্ড নেওয়ার সময়সীমা শেষ হলেও অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার সময়সীমা শেষ হয়নি। যারা এখনো বৈধ হতে পারেনি তারা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের মাধ্যমে বৈধ হতে পারবে। ’
হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে মালয়েশিয়া সরকার ই-কার্ডের সুযোগ দিয়েছিল। ই-কার্ড নেওয়া কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগও নিয়েছে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক। তিনি বলেন, এর পরও যারা এখনো অবৈধ হিসেবে অবস্থান করছে তাদেরকে দ্রুত নিবন্ধনের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আটক অবৈধ শ্রমিকদের ১৪ দিন সময় দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যদি তারা বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারে তাহলে তারা মুক্তি পাবে। আর বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারলে বন্দিশিবিরে (ডিটেনশন সেন্টার) পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ার জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া সাভারের হেমায়েতপুরের জয়নাবাড়ীর রবিউল ইসলামের ছেলে মান্নান মিয়া টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, দেড় বছর আগে ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। এখন অবৈধভাবে পেনাংয়ে আছেন। অভিযান শুরুর পর বাসা ছেড়ে পাশের পাম বাগানে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আরো পাঁচজন আছে।
মান্নান বলেন, ‘ভাই, একটুর জন্য আমরা বেঁচে গেছি। আমাদের পাশের এলাকায় রেইড দিয়েছে। মশার কামড় খেয়েই রাত পার করেছি। ’
ই-কার্ড কেন করেননি জানতে চাইলে মান্নান বলেন, ‘ই-কার্ড করতে খরচ পড়ে তিন হাজার রিঙ্গিত। আর নিবন্ধনের মাধ্যমে বৈধ হতে লাগে ছয় থেকে সাত হাজার রিঙ্গিত। অভাবের সংসারের কথা চিন্তা করে বৈধ না হয়ে দেশে টাকা পাঠিয়েছিলাম। ’
এ ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থান করে কুয়ালালামপুরের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন রাজধানীর শেরেবাংলানগরের মো. ফারুক মিয়ার ছেলে সোহেল রানা। অভিযান শুরুর পর আতঙ্কের কথা জানিয়ে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লেখাপড়া করতে এসে দালালের কারণে এখন আমি শ্রমিক। কিন্তু অবৈধ হতে গিয়ে হতে পারছি না। কারণ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট না দিয়ে আউট পাস করায় আমার বৈধ হতে সমস্যা হচ্ছে। পুলিশ যেকোনো সময় আটক করতে পারে। ’
বাংলাদেশে থাকা সোহেল রানার মা আলো বেগম বলেন, ‘ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে নিজেরাই আতঙ্কে আছি, কোন সময় পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। ’
এ রকম আরেকজন কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামের আহাম্মদ আলীর ছেলে সাজিদুর রহমান। অবৈধভাবে অবস্থান করে মালয়েশিয়ার গেন্টিংহিলের পাশের একটি হোটেলে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে অভিযান শুরুর পর মালিক ফোন করে কাজে যেতে নিষেধ করেছেন। ’
একই হোটেলের কর্মী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘খাওয়াদাওয়া শেষে বাড়িতে পাঠাতে পারি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বৈধ হতেই যদি বছরে দেড় লাখ টাকা চলে যায়। তাহলে সংসার চলব কিভাবে? এসব চিন্তা করেই বৈধ হইনি। ’
এদিকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যেন কোনোভাবেই ভ্রমণ ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা কিংবা প্রফেশনাল ভিসায় মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য না আসে। মালয়েশিয়ায় আসতে হলে সরকারিভাবে বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেন আসে। ’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে (সরকারিভাবে) প্রতিদিনই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হচ্ছে। অথচ একটি অসাধু সিন্ডিকেট ট্যুরিস্ট ভিসা কিংবা স্টুডেন্ট ভিসায় কর্মী পাঠাচ্ছে। এ কারণে ওই শ্রমিকরা বিপদে পড়ছে। ’
অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় না গিয়ে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে বৈধভাবে যাওয়ার পরামর্শ দেন রুহুল আমিন স্বপন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় বৈধ শ্রমিকের অনেক চাহিদা রয়েছে। তাই যারা এখন মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে আছেন তিনিও তাঁদের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধনের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন।
মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইটস টাইমস অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে এক হাজার ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৫ জনই বাংলাদেশি।
রাজধানী কুয়ালালামপুর ছাড়াও পেরাক, জোহর বারু, কোতা বারু, কেলান্তান, কেদাহ, আলোর সেতার, মালাকাসহ প্রত্যন্ত প্রদেশেও অভিযান চালাচ্ছে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক মুস্তফার আলী স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দেশজুড়ে ১৫৫টি স্থানে অভিযান চালানো হয়। তিন হাজার ৩৯৩ জন সন্দেহভাজন বিদেশির কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়। এতে এক হাজার ৩৫ জন অবৈধ বিদেশি শ্রমিক পাওয়া যায় এবং তাদের আটক করা হয়েছে।
ই-কার্ডের জন্য আবেদন করার সময়সীমা বাড়ানো হবে কি না এমন প্রশ্নে মুস্তফা আলী বলেন, ‘আবেদনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ফলে সময়সীমা নতুন করে বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। এ বিষয়ে চাকরিদাতা ও অবৈধ শ্রমিকদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এখন থেকে প্রতিদিনই অভিযান চালানো হবে। ’
মালয়েশিয়ার অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ছয় লাখ অবৈধ বিদেশি শ্রমিক অবস্থান করছে। বৈধ হওয়ার জন্য এ পর্যন্ত আবেদন করেছে এক লাখ ৬১ হাজার ৫৬ জন, অর্থাৎ মাত্র ২৩ শতাংশ।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া।