কক্সবাজারের টেকনাফের স্থলবন্দরে পণ্য আমদানির অজুহাতে ব্যাংকের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে ফরেন ডিমান্ড ড্রাফটে (এফডিডি) ডলার হিসেবে পাচার করা হয় এই অর্থ। উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট এই অর্থ পাচারে জড়িত। শুরুতে সোনালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখা থেকে এসব এফডিডি পাঠানো হলে গত ১ বছর আগে সোনালী ব্যাংক এই গ্রাহকসেবা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্তও এবি ব্যাংক এই সুবিধা চালু রেখেছিল। তবে অক্টোবর থেকে এবি ব্যাংকও এই ড্রাফট পাঠানো বন্ধ রেখেছে।
ডলারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ আদায়ের মাধ্যমে পাঠানো এসব মুদ্রা পাচারের বিপরীতে ব্যাংক ম্যানেজার বছরে আদায় করতেন ৫২৫ কোটি টাকারও বেশি। এই আদায়ের ভাগ পেতেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই।
Rupali Bank
সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি
Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন
এ বিষয়ে জানতে এক মাস ধরে সোনালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। এ সময় তাদের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে এফডিডি নিয়ে কথা বলতে চাওয়া হয়। কিন্তু এ ব্যাপারেও কোনো কথা বলা যাবে না বলে জানিয়ে দেন তারা।
সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর এবি ব্যাংকে টেকনাফ শাখার ম্যানেজার মনজুরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে চলতি অক্টোবর থেকে মিয়ানমারে এফডিডি পাঠানো বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় এবং তা বণ্টন করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।’
চলতি বছরে মাসওয়ারি পাচারের চিত্র
ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, মিয়ানমারে এক বছর ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর তীব্র সংঘাত চলছে। যে কারণে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি একেবারেই কমে গেছে। তারপরও বন্দরে পণ্য আমদানির নামে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বা ৭০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে। অথচ এর বিপরীতে এই ৮ মাসে টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে পণ্য এসেছে ২৯৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত পাঠানো হয়েছে।
এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪০৬টি এফডিডি পাঠানো হয়। যার ডলার মূল্য ৬৯ লাখ ৯০ হাজার ৫৪০। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ৭৮৪ কোটি ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৪ টাকা। ২৯ হাজার ৯০ ডলার মূল্যের প্রতিটি ড্রাফট করতে ব্যাংককে অতিরিক্ত হিসেবে কমপক্ষ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগÑ এভাবে ১২০ কোটি ৩০ টাকা এই ৮ মাসে হাতিয়ে নিয়েছেন ব্যাংক ম্যানেজার।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, জানুয়ারি মাসে এবি ব্যাংক টেকনাফ শাখা থেকে পাঠানো হয়েছে ৪০০ ড্রাফট। যার মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ডলার বা ১২৭ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অথচ এর বিপরীতে টেকনাফ বন্দরে পণ্য এসেছে ৩৯ কোটি ১০ লাখ ৫৭ হাজার ৯৫২ টাকার। জানুয়ারি মাসে পাঠানো ৮৮ কোটি ৮৯ লাখ ২ হাজার ৪৮ টাকার পণ্য আসেনি। অথচ এই ড্রাফট পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজার আদায় করেছেন ২ কোটি টাকা।
ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রাফট পাঠানো হয়েছে ৩৪২টি। এর মূল্যমান ৯৯ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮০ ডলার বা ১০৯ কোটি ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ টাকা। এর বিপরীতে পণ্য এসেছে ৮৫ কোটি ৪৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭২৫ টাকার। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পাঠানো হয়েছে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫ টাকা। ব্যাংক ম্যানেজার অতিরিক্ত আদায় করেছেন ১ কোটি ৭১ লাখ।
মার্চ মাসে ৩২০টি ড্রাফটে পাঠানো হয় ৯৩ লাখ ৮ হাজার ৮০০ ডলার। বাংলাদেশি অর্থে যার মূল্যমান ১০২ কোটি ৩৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। কিন্তু পণ্য এসেছে ৩৮ কোটি ২২ লাখ ১৭ হাজার ৪৮২ টাকার। অতিরিক্ত পাঠানো হয়েছে ৬৪ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ টাকা। এখানে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এপ্রিল মাসে পাঠানো ড্রাফট ৩২৪টি। ৯৪ লাখ ২৫ হাজার ১৬০ ডলার বা ১০৩ কোটি ৬৭ লাখ ৬৭ হাজার ৬০০ টাকা পাঠানোর বিপরীতে ওই মাসে পণ্য আমদানি হয় ৩৬ কোটি ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ টাকার। অতিরিক্ত পাঠানো হয় ৬৭ কোটি ১ লাখ ২১ হাজার ৬২৩ টাকা। ব্যাংক ম্যানেজার হাতিয়ে নেন ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
মে মাসে ৩৪০টি ড্রাফটে পাঠানো হয় ৯৮ লাখ ৯০ হাজার ৬০০ ডলার বা ১১২ কোটি ৭৫ লাখ ২৮ হাজার ৪০০ টাকা। পণ্য আনা হয় ৩৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৪ টাকার। অতিরিক্ত পাঠানো হয় ৭৯ কোটি ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৬ টাকা। এক্ষেত্রে ম্যানেজার হাতিয়ে নেন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
গত জুনে ২৭০টি ড্রাফটে পাঠানো হয় ৭৮ লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ ডলার বা ৮৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ২০০ টাকা। পণ্য এসেছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯০৪ টাকার। অতিরিক্ত পাঠানো হয়েছে ৭০ কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ টাকা। ব্যাংক ম্যানেজার হাতিয়ে নিয়েছেন ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
গত জুলাই মাসে ১৯৫টি ড্রাফটে ৫৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৫০ ডলার বা ৬৪ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার ৭০০ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু পণ্য এসেছে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৪১ হাজার ৯৮১ টাকার। ৫ কোটি ৩২ লাখ ২৮ হাজার ৭১৯ টাকার অতিরিক্ত ড্রাফটে ব্যাংক ম্যানেজার হাতিয়ে নিয়েছেন ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
আগস্ট মাসে ২১৬টি ড্রাফটে ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪০ ডলার বা ৭১ কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা পাঠানো হয়েছে। স্থলবন্দরে ২৬ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার ৯৫৩ টাকার পণ্য এলেও অতিরিক্ত পাঠানো হয় ৪৪ কোটি ৭৩ লাখ ৯১ হাজার ২০৭ টাকা। এভাবে ব্যাংক ম্যানেজার হাতিয়ে নেন ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই ৮ মাসের প্রাপ্ত তথ্যমতে, টেকনাফ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কোটি টাকা করে পাঠানো হয়ে মিয়ানমারে। অথচ পণ্য এসেছে তার অর্ধেক বা এর কম-বেশি। ফলে প্রতি মাসে ৫০ কোটি করে বছরে ৬০০ কোটি টাকার কোনো পণ্যই আসেনি। এই হিসাব মতে, গত ১৫ বছরে টেকনাফ থেকে মিয়ানমারে পাঠানো পাচার হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।
যা বলছেন ব্যবসায়ী নেতা
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা প্রশ্ন তুলেছেন, এই ৯ হাজার কোটি টাকা কি গত ১৫ বছর ধরে সেখানে পাচার হয়েছে? তিনি বলেন, ‘টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানির জন্য টেকনাফের দুটি ব্যাংক থেকে এফডিডি পাঠানো হয়। প্রশ্ন হলো, পাঠানো অর্থের বিপরীতে পণ্য আমদানি যদি না-ই হয়, তাহলে ওই অর্থ কেন পাঠানো হয়েছে?’
তিনি বলেন, ‘এখানে পাঠানো অর্থ ও পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের ব্যবধান রয়েছে। ফলে অতিরিক্ত পাঠানো অর্থ কিসের জন্য গেছে, তার উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। মিয়ানমার থেকে মাদকদ্রব্য ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস পাচার হয়ে আসছে। তাহলে কি এই মাদকের জন্য অতিরিক্ত ডলার মিয়ানমারে পাচার করা হয়েছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের ড্রাফটের বিপরীতে পণ্য আসছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দেখার কথা। যদি পণ্য না আসে, তাহলে ড্রাফট পাঠানো ব্যক্তিদের নোটিস দিয়ে জানতে চাওয়ার নিয়ম রয়েছে। নোটিসের সঠিক ব্যাখ্যা না পেলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের জানানোর বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো তা করেছে কি না তা-ও তদন্ত করা দরকার।’
এভাবে মূলত মিয়ানমারে অর্থ পাচার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি ড্রাফট পাঠানো ব্যক্তি ও জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট প্রধান সাবেক এমপি বদি
টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি করতে এফডিডি পাঠানোর জন্য একটি লাইসেন্স ব্যবহার করতে হয়। স্থানীয় পৌরসভা এই লাইসেন্স দিয়ে থাকে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের। টেকনাফে এবি ব্যাংকের এমন লাইসেন্সধারী ৫৫০ জনের মধ্যে গত ১৫ বছরে ড্রাফট সুবিধা পেয়েছেন কেবল ৫০-৭০ জন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী পরিচয় গোপনের শর্তে বলেছেন, ‘এই ৫০-৭০ জনের সিন্ডিকেট প্রধান ছিলেন উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তিনিই ঠিক করে দিতেন কে কতটা ড্রাফট তৈরি করবে। ড্রাফট প্রস্তুতকারী ব্যক্তি এসব ড্রাফট সরাসরি মিয়ানমারের প্রতিনিধির অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন না। তৈরি করা ড্রাফট বিক্রি করা হতো তৃতীয় ব্যক্তির কাছে। প্রতিটি ২৯ হাজার ৯০ ডলারের ড্রাফট তৈরি করতে ব্যাংক ম্যানেজারকে দিতে হতো ৫০ হাজার টাকার বেশি। আর প্রতিটি ড্রাফট ১ ডলারের বিপরীতে ৬-৭ ডলার অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করা হতো তৃতীয় জনের কাছে। এই তৃতীয় জনের দেওয়া মিয়ানমারের প্রতিনিধির নামেই পাঠানো হতো এই ড্রাফট। এ ধরনের ড্রাফট পাঠানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছেন আবদুর রহমান বদি নিজেই। তার সঙ্গে রয়েছেন তার ভাই আবদুস শুক্কুর ও মৌলভী মুজিবুর রহমান, ভগ্নিপতি ওমর ফারুক এবং ছেলে শাওনও। অন্যদের মধ্যে সাইফুদ্দিন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, রফিকসহ কয়েকজন রয়েছেন শীর্ষ অবস্থানে।
ড্রাফট ক্রয়কারী তৃতীয় ব্যক্তি হুন্ডি কারবারি কি না, সেটা দেখা জরুরি বলে অভিমত দিয়েছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।
প্রেক্ষাপট
ড্রাফট বিক্রির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ বা ব্যাংক ম্যানেজারের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় আসে ২০২২ সালের শেষদিকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় সোনালী ব্যাংকের সহকারী শাখা ব্যবস্থাপককে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি করা হয়। তবে পরে আর কী হয়েছে তা জানা যায়নি। ওই সময়ের পর সোনালী ব্যাংক ড্রাফট পাঠানো বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এবি ব্যাংক তারপরও ড্রাফট পাঠানো অব্যাহত রাখে।
ড্রাফট পাঠানো ব্যক্তিরা বলছেন, এসব ড্রাফট তৈরি করে ব্যাংকে ইস্যু করতে আওয়ামী লীগের টেকনাফ উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের নেতাদেরও অর্থ দিতে হয়েছে। ব্যাংক থেকে এসব নেতার ফোনেই তৈরি করা হতো ড্রাফট। সুত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ