[caption id="attachment_26293" align="aligncenter" width="725"] ফাইল ছবি[/caption]
মিয়ানমার কর্তৃক সে দেশের লাখ লাখ নাগরিককে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া কোনো রকমের যুদ্ধ-উসকানির সংজ্ঞায় পড়ে কি না, সে বিষয়ে ভূরাজনীতি বিশারদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কিন্তু দেশটির যে তৎপরতা সে রকম আলোচনায় কখনো আসে না তা হলো বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত অবাধে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করতে দেওয়া। রোহিঙ্গা এসেছে প্রায় আট লাখ এবং বাংলাদেশ আপাতত কয়েক বর্গমাইলের মধ্যে ঘিরে রেখেছে তাদের। কিন্তু ‘চম্পা’, ‘রেড ডগ’, ‘আর-সেভেন’ ইত্যাদি আসছে মাসের পর মাস, প্রতিদিনই কয়েক লাখ করে এবং ৫৫ হাজার বর্গমাইলজুড়েই এখন এর বিস্তার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এখন এমন গ্রাম পাওয়া কঠিন, যেখানে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে কেবল ইয়াবা বড়ি আটক হয়েছে ৪ কোটি, যা ২০১০ সালের চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বেশি এবং আগের বছরের চেয়ে ১ কোটি ১০ লাখ পিস বেশি। একটি ইয়াবা বড়ির মূল্য রাজধানী পর্যায়ে ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। সাধারণত আটক মাদককে প্রকৃত চোরাচালানের ২০ ভাগের ১ ভাগ হিসাবে অনুমান করা হয়। এই হিসাবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কেবল ইয়াবাই আসছে বছরে অন্তত ৮০ কোটি পিস, অর্থাৎ মাথাপিছু প্রত্যেক বাংলাদেশির জন্য বছরে গড়ে ৫টি ইয়াবা আসছে বলা যায়; যার বাজারমূল্য ন্যূনপক্ষে ২৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ৬০০ কোটি টাকার বেশি নয়।
কক্সবাজারের সাংবাদিক মঈনুল হাসানের মতে, এটা একটা দুর্যোগে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের জন্য; কিন্তু সে কথা জোর দিয়ে বলছে না কেউ। তাঁর মতে, ইয়াবাবাণিজ্য ছাড়া কক্সবাজারে উল্লেখযোগ্য নতুন কোনো অর্থনৈতিক তৎপরতা নেই এখন। যে প্রশাসনের এটা রুখে দাঁড়ানোর কথা, তার মানবসম্পদের মধ্যেই ইয়াবা–আসক্তি ব্যাপকতা পেয়ে গেছে। তাঁর মতে, কক্সবাজার একটা এন্ট্রি পয়েন্ট হলেও বড় চালানগুলো সরাসরি ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে চলে যাচ্ছে। আসন্ন পরিস্থিতিকে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার সঙ্গে তুলনা করলেন তিনি।
কক্সবাজারে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে কাজ করে, এমন একটি সংস্থা ‘নোঙর’। এর কর্মকর্তা রাশেদ দিদারুলের অনুমান, কেবল তাঁদের জেলায় ইয়াবা–আসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত নোঙরে এরই মধ্যে সাড়ে সাত হাজার মাদকাসক্তকে ‘চিকিৎসা’ দেওয়া হয়েছে। তরুণ দিদারুল বারবার বলছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য হারে’ ইয়াবার সরবরাহ ও ভোক্তা বাড়ছে, বিশেষ করে ভোক্তা ও বিক্রেতাদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। রাশেদ দুঃখ করে বললেন, ‘পুরো দেশের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চলছে, অথচ সবাই আনন্দচিত্তে তাতে শরিক। পুরো কক্সবাজার ইয়াবা থেকে আয়ের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত।’
মঈনুল হাসান এবং রাশেদ দিদারুলের উদ্বেগ ও অভিমতকে অতিশয়োক্তি বলার সুযোগ কম। গত ১০ মে গণচীনের ইংরেজি সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস-এ কক্সবাজারকে ‘মেথ-টাউন’ (‘ইয়াবা শহর’) হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে মিয়ানমারের মাদক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক দুশ্চিন্তারও কারণ ঘটিয়েছে।
দুই
মিয়ানমারের আর্থসামাজিক ইতিহাসের প্রতি আগ্রহীমাত্রই জানেন, বহুকাল যাবৎ দেশটির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে আফিম উৎপাদন ও বিপণনে। আফগানিস্তানের পর মিয়ানমার হলো আফিম উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান দেশ। তবে সম্প্রতি আফিমের চাহিদা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে মেথামফেটামিন–জাতীয় মাদকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশটির মাদকশিল্পে রীতিমতো উল্লম্ফন ঘটেছে।
মিয়ানমারের শান প্রদেশ হলো বর্তমান বিশ্বে মাদকদ্রব্য উৎপাদনের এক বড় কেন্দ্র। তবে এখন শান ছাড়া কাচিনসহ আরও বহু এলাকায় মেথামফেটামিন উৎপাদিত হচ্ছে এবং বহু পথ ঘুরে তা সুনামির ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গীকার না থাকায় একদিকে সীমান্তে মেথামফেটামিনের ঢেউ রোখা যায়নি, অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয়ভাবেও মিয়ানমারকে মাদক চোরাচালান বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করা যায়নি।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সে দেশের ইয়াবা উৎপাদন ও চোরাচালান বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। এ সময় বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দেশের ৫০টি ইয়াবা উৎপাদন কারখানার নাম ও অবস্থানের তালিকাও হস্তান্তর করেছিল।
তবে মিয়ানমারের পক্ষে উৎপাদন বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সহজ নয়। কারণ, দেশটির যেসব এলাকায় ইয়াবা বেশি মাত্রায় উৎপাদিত হয়, সেখানে বিরাজ করছে আধা যুদ্ধাবস্থা। ইয়াবা উৎপাদন ও বিপণনকে ঘিরে সচরাচর কোনো না কোনো স্থানীয় সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয়। ইয়াবা তৈরির ল্যাবরেটরি বা কারখানাগুলোর অধিকাংশই জঙ্গলে এবং কোথাও কোথাও তা মোবাইল ধাঁচের। তবে মিয়ানমার চাইলে ইয়াবার পরিবহন রুটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে দেশের সরকারের প্রশাসনিক অঙ্গীকার জোরালো নয়। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে অং সান সু চির এনএলডি নয়, দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কাজের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে নাফ নদীর এপারেও প্রশাসনিক অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোরাচালান পিরামিডের ভিত্তিস্বরূপ ব্যক্তিরা আটক হন না; মাঝেমধ্যে কিছু ইয়াবা উদ্ধার হয় ‘পরিত্যক্ত অবস্থায়’। সীমান্তে মাদকযুদ্ধ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের সঙ্গে তুলনা করলে। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত প্রায় ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর বাংলাদেশ পাহারা দিচ্ছে মিয়ানমারকে মাত্র ২৭২ কিলোমিটার এলাকায়। অথচ ভারত সীমান্তে মিয়ানমারের মাদক চোরাচালান অনেক সীমিত। যদিও মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তে ইয়াবা উৎপাদনের বিকাশ মূলত ভারতীয় কাঁচামাল সুডোয়েফেড্রিন থেকে; Ñকিন্তু দুই দেশই তা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট। এ বছরই ২৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুনে উভয় দেশের মধ্যে এ বিষয়ে তৃতীয় আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা সম্মেলন হয়ে গেল।
তিন.
মিয়ানমারের মাদকসাম্রাজ্য নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে সোচ্চার না হলেও বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১২-১৩টি দেশ এ বিষয়ে সক্রিয়। এর মধ্যে আছে চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ। ফলে মিয়ানমারের ওপর এ ক্ষেত্রে চাপ রয়েছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক অফিস ইউএনওডিসিকে ব্যবহার করে এই চাপ তৈরি হচ্ছে। মাদক বিষয়ে ১৯৬১ সালের আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং ১৯৭২ সালের বহুল আলোচিত প্রটোকলটি ছাড়া আরও অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে। এসব আইনগত দলিল ব্যবহার করেই বিভিন্ন দেশ ইউএনওডিসিকে কাজে লাগাচ্ছে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে।
প্রাথমিকভাবে এই চাপ শুরু হয় আফিম উৎপাদনকে ঘিরে। ইয়াবা ও হেরোইনের মতো আফিম উৎপাদনেরও কেন্দ্রভূমি এখনো শান প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এলাকা। থাইল্যান্ড ও লাওস সীমান্তবর্তী মে কং এবং রুয়াক নদী সন্নিহিত মিয়ানমারের এই এলাকায় দেশটির সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সামান্যই। এলাকাটি এখন শান স্টেট আর্মি-সাউথ (এসএসএ-এস) ও ইউনাইটেড ওয়া আর্মি নিয়ন্ত্রণ করে। মিয়ানমারে যেসব সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে সরকারের এখনো যুদ্ধবিরতি নেই, তার দুটি হলো এসএসএ-এস এবং ওয়া আর্মি। কিছু কিছু ইয়াবার গায়ে যে ডব্লিউ-ওয়াই চিহ্ন থাকে, সেটা মূলত ওয়া আর্মির চিহ্ন। ওয়া আর্মির সৈন্যসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এ থেকে তাদের শক্তি ও মাদক অর্থনীতির শক্তিÑ উভয়ই আঁচ করা সম্ভব। অবশ্য ইয়াবার উৎপাদন থেকে আয় বেশি পরিবহনকারীদের; উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে মূল্যের পার্থক্য প্রায় ৫০ গুণ।
উল্লেখ্য, আগে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল নিয়ন্ত্রণ করত খুন সার মং থাই আর্মি। ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর খুন সা মারা যাওয়ার পর মং থাই আর্মি এখন প্রায় পুরোপুরি এসএসএ-এসের সঙ্গে মিশে গেছে। ইউএনওডিসির হিসাবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে অন্তত ৫০টি ল্যাব রয়েছে এবং সেখানে বছরে ইয়াবা বড়ি উৎপাদিত হয় প্রায় ১০০ কোটি পিস। থাই ও লাওসের সীমান্তপথেই এর প্রধান অংশ পাচার হয়ে যায়। শান ও কাচিনে ইয়াবা তৈরির কাঁচামালও চোরাইপথে আসছে মুখ্যত চীন থেকে।
চীন-থাইল্যান্ড-লাওসমুখী উৎপাদন ও পাচারপথ মিয়ানমার আর্মি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও বাংলাদেশমুখী চালানগুলো বন্ধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব। কারণ, এই রুট মূলত মিয়ানমারের কেন্দ্র দিয়ে কক্সবাজারমুখী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত ইউএনওডিসির সঙ্গে আরও নিবিড় যোগাযোগ এবং তাদের কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে শরিক হওয়া। তবে তার আগে প্রয়োজন নিজের ঘরে শুদ্ধি অভিযান।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক