নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাও সোচ্চার হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মিয়ানমারের প্রতি চাপ বাড়ছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানও এখন মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। এছাড়া রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে রবিবার মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০ হাজার লোক বিক্ষোভ করেছেন।
সূত্র জানায়, মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সমর্থন চেয়েছিল বাংলাদেশ। এ সমস্যা দ্রুত সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ দিলে এ সমস্যার সমাধান মিলতে পারে। সে কারণে বাংলাদেশ চাইছে বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে মিয়ানমারকে চাপ দিক। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে মিয়ানমার পরিস্থিতিও তুলে ধরে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে রবিবার মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০ হাজার লোক বিক্ষোভ করেছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ওই বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে মিয়ানমারের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতও শান্তিপূর্ণ সমস্যার সমাধান আশা প্রকাশ করেছে। আর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। এছাড়া শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সুচির বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক গণমাধ্যমে তার ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই অভিযোগ করেছেন, জাতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে তাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-শিশু নির্যাতন, ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া এবং লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের উর্ধতন কর্মকর্তা জন ম্যাককিসিক জািনয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, শিশুদের জবাই করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে।
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী গত সপ্তাহে দিল্লীতে এক অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য অন্য দেশগুলোর প্রতিও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে অন্য দেশগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশ রাখাইন সীমান্ত বন্ধ করেনি। অন্য দেশগুলোরও উচিত এ উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়া।
মিয়ানমার সীমান্তে সামরিক বাহিনীর অভিযানের পর হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেরই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসতভিটা ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এদের মধ্যে অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। আবার অনেকেই বাংলাদেশে আসার জন্য সীমান্তে অপেক্ষা করছেন।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সে দেশের ৯ সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এদিকে, দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মিয়ানমার সীমান্তের ঘটনায় ইতোমধ্যেই প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করে বাংলাদেশ সরকার।
সোচ্চার মালয়েশিয়া ॥ মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে রবিবার এক বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রায় ১০ হাজার লোক বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে কুয়ালালামপুরে টিটিওয়াংসা স্টেডিয়ামে এ বিক্ষোভ সমাবেশে হাজার হাজার লোক ‘গণহত্যা বন্ধ করো’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন। আবার অনেকেরই প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘রোহিঙ্গাদের রক্ষা করো’। তারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধেও সেøাগান দেন। সমাবেশে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও অন্যতম বিরোধী দল ইসলাম সেমালয়েশিয়ার (পিএএস) সভাপতি আবদুল হাদি আওয়াংসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা যোগ দেন। সমাবেশে কয়েক হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীও অংশগ্রহণ করেন।
রবিবার মালয়েশিয়ার স্টার ও সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নির্যাতনবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে হবে। তারা আমাদের একই ধর্মে বিশ্বাসী এটা বড় বিষয় নয়, তারা মানুষ। তাদের জীবনেরও মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোকেও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। নাজিব আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু হলো ইসলামের অপমান। আমাদের ধৈর্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
বিরোধী দল পিএএস নেতা আবদুল হাদিসহ অনেক নেতাকর্মী ওই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তারা রোহিঙ্গা নিপীড়নের সমালোচনা করেছেন। মালয়েশিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী সেখানে প্রায় ৫৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন। ওই শরণার্থীদের অনেকেই বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ফয়সাল ইসলাম মুহাম্মদ কাসিম রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মালয়েশিয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা চাই মালয়েশীয় সরকার মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের বার্তা পৌঁছে দিক। এতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়বে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপন্নতায় যে দেশগুলো সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছে মালয়েশিয়া তাদের অন্যতম। মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন মালয়েশিয়া নামের এক সোসাইটিও গঠন করেছে মালয়েশিয়া সরকার। আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমার সরকারের কাছে মালয়েশিয়া উদ্বেগ জানিয়ে ইতোমধ্যেই চিঠি পাঠিয়েছে। জাতিসংঘের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারে সে দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে মালয়েশিয়া। দেশটির একজন মন্ত্রী মিয়ানমারের আসিয়ান সদস্যপদ বাতিলেরও আবেদন জানিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ॥ মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষিতে স্বাধীন, নিরেপক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সেখানকার সহিংসতার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও উদ্বিগ্ন বলেও জানিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ ও সমমনা দেশগুলোকে রাখাইন প্রদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করারও আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, মিয়ানমারের সীমান্তের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সেখানকার সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশসহ সমমনা সকল দেশকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।
মার্শা বার্নিকাট আরও বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অভিযানের পর সেখানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই সেখানে কী ঘটছে তা আমরা পুরোপুরি জানি না। এ কারণে সেখানকার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি স্বাধীন, পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত সহিংসতায় নিন্দা জানান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তিনি বাংলাদেশ ও সমমনা দেশগুলোকে রাখাইন প্রদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করারও আহ্বান জানান।
মিয়ানমারে কফি আনান ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের ঘটনায় মিয়ানমার সফরে রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। শুক্রবার তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা পরিদর্শন করেন। সে সময় কফি আনান সেখানকার উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েন। শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিট্যুয়তে যান কফি আনান। সেখানে কফি আনান পৌঁছলে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন কয়েক শ’ বিক্ষোভকারী। অবশ্য এর আগেও মিয়ানমার সফরকালে দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের এমন বিক্ষোভের মুখে পড়েন জাতিসংঘের সাবেক এই মহাসচিব। কফি আনানের সঙ্গে তার নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা কমিশনের সদস্যরা রয়েছেন। তারা আরাকানের স্থানীয় রোহিঙ্গাদের গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেন। সরকারী বাহিনীর অগ্নিসংযোগ করা ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপও পরিদর্শন করেন। নির্যাতনের শিকার মানুষজনের সঙ্গেও কথা বলেন তারা। মিয়ামারের রোহিঙ্গাবিষয়ক কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশটিতে কফি আনান দ্বিতীয়বারের মতো সফর করছেন। এর আগে অব্যাহত রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় গত সেপ্টেম্বরে দেশটি সফর করেন কফি আনান। এছাড়া গত ১৬ নবেম্বর এক বিবৃতিতে কফি আনান মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, তিন দশক ধরে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
সুত্র: জনকন্ঠ
পাঠকের মতামত