[caption id="attachment_5804" align="alignleft" width="445"] ইয়াবা তৈরির যন্ত্র[/caption]
উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারের ৩৭ কারখানার ইয়াবায় সয়লাব হচ্ছে বাংলাদেশ। পাচারকারীদের সঙ্গে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না প্রশাসন। মিয়ানমারের ৮টি সংগঠনের ৩৭ কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা ১৭ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের ৭ শতাধিক সাব ডিলারের হাত হয়ে বিভিন্ন শ্রেণির ক্রেতাদের কাছে। পাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও।
গত দুই বছরে র্যাব ও কোস্টগার্ড মিলে আটক করেছে প্রায় দেড় কোটি পিস ইয়াবা। যার সিংহভাগই এসেছে সমুদ্রপথে। সর্বশেষ সোমবার দিবাগত রাতে কোস্টগার্ড পূর্বজোন চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং পতেঙ্গা বহির্নোঙর থেকে মোট ১০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি ১৮ লাখ ৮৬৭ টাকা। এ ঘটনায় দয়াল কৃষ্ণ (৪০) ও মো. হোসেন (৫৫) নামে দু জনকে আটক করা হয়েছে।
জলপথে নজরদারি বাড়লে স্থলপথ আবার স্থলপথে নজরদারি বাড়লে জলপথকে বেছে নিচ্ছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছে ৩০ লাখ ইয়াবা। এর কিছু অংশ প্রশাসনের হাতে নানাভাবে ধরা পড়লেও সিংহভাগ থেকে যাচ্ছে অধরা। মিয়ানমার সীমান্তে নাসাকা মালিকানাধীন ৩৭ ইয়াবা কারখানায় তৈরি হয় ১৩ ধরনের ইয়াবা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশের মইং, শানাইস্টিস, টেংইং, সেন, কাইয়াং, কেউও, কাশিন ও আইক্কা নামক শহরে ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ইয়াবা উৎপাদন করা হয় সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ড থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে।
এসব কারখানার মধ্যে মিয়ানমারের কুখাই এলাকায় কেচিন ডিফেন্স আমিব্রই রয়েছে ১০টি কারখানা। নামকখাম এলাকায় পানশে ক্যাও ম্যাও অং মৌলিন গ্রুপের কারখানা রয়েছে দু’টি। কুনলং এলাকার স্পেশাল পুলিশ এক্স হলি ট্র্যাক্ট গ্রুপের রয়েছে একটি, এক নম্বর ব্রিগ্রেড তাংইয়ান এলাকায় ম্যাংপাং মিলিশিয়া ও মংঙ্গা মিলিশিয়া শান স্টেট আর্মির (নর্থ) রয়েছে একটি করে কারখানা।
লুই হুপসুর (মংশু) এলাকায় ইয়ানজু গ্রুপের একটি কারখানা ও নামজাং, মাহাজা অ্যান্ড হুমং এলাকায় শান ন্যাশনালিটিজ লিবারেশন (এসএনপিএল) অ্যান্ড কাই-সান চুউ শাং (নায়াই) গ্রুপের রয়েছে চারটি কারখানা, কাকাং মংটন এলাকার ইউনাইটেড ওয়া এস্টেট আর্মির (ইউডব্লিউএসএ) আছে আরও তিনটি ইয়াবা কারখানা।
এছাড়া মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং, মংইয়াং ও পাংশাং এলাকায় ইউনাইটেড ওয়া এস্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ) ও লাহু মিলিশিয়ার কারখানা রয়েছে ১০টি। মাওকমাই এলাকায় শান ন্যাশনালিটিজ পিপল আর্মির রয়েছে দু’টি কারখানা, কোকান এলাকায় মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির কারখানা রয়েছে (এমএনডিএএ) একটি।
এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি করা হয়। এরমধ্যে ডব্লিউওয়াই, ৮৮৮আর২, ওকে, গোল্ড, টাইগার, এইচসিআর্ট, চিকেন ওয়ার্ল্ড, স্কালহোয়ে, হর্স-সুয়ে, হর্স হেড এবং ফ্লাওয়ার অ্যান্স এলর্টাট উল্লেখযোগ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা আসা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই প্রদেশ থেকে আসতো এসব ইয়াবা। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ইয়াবার ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অর্থের যোগান বাড়ায়। একই সঙ্গে মিয়ানমার প্রশাসনের মদদে সে দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা কারখানা স্থাপন ও ইয়াবা পাচার বাড়ায়।
অনুসন্ধানে মিয়ানমারের শীর্ষ ১৭ জন ডিলারের কথা জানা যায়। এর মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন মংডু এলাকার শফিউর রহমানের ছেলে মো. আলম (৩৭), আকিয়াবের ফয়েজপাড়ার কেফায়েত আলীর ছেলে মো. সৈয়দ (৩৫), মংডুর গোজাবিল এলাকার মৃত খুল মোহাম্মদের ছেলে কালা সোনা (৪০) এবং একই এলাকার আবদুল মোতালেবের ছেলে মোহাম্মদ নুর (৩২)। এসব ডিলার এদেশীয় ১৭ জনেরও বেশি ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ওইসব কারখানায় তৈরি করা ইয়াবা বাংলাদেশে সরবরাহ করছে।
এই ১৭ জন শীর্ষ ডিলার পরিচালিত হয় টেকনাফের শক্তিশালী দু’টি ইয়াবা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো টেকনাফের স্থানীয় সংসদ সদস্যের চার ভাই, এপিএস, ভাগ্নে ও তালতো ভাইয়ের একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অন্য সিন্ডিকেটের গড ফাদারের নাম এখন পর্যন্ত কোনো গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আসেনি।
মিয়ানমারে উৎপাদিত এসব ইয়াবা বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে পৌঁছে দেয়া হয়। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করা হয় ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজও। এছাড়াও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারীদের গোপনাঙ্গে এবং শিশুদের মলদ্বারে বিশেষ পদ্ধতিতে দেড় থেকে দু’হাজার ইয়াবা পাচার করা হয়।
মিয়ানমারের ফেডারেল পার্লামেন্ট ও শান স্টেট লেজিসলেচার (সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) ও বিচ্ছিন্নাতবাদী দলের নেতৃত্বস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে মংডু, বুথিডং এলাকায় সদ্য লুপ্ত নাসাকা বাহিনী (বর্তমানে লুটিং), সেনা কর্মকর্তা, কাস্টমস অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর যোগাযোগ থাকায় শান স্টেট থেকে ইয়াবা আসার সময় কোনো সমস্যা হয় না। বিভিন্ন চেক পয়েন্টে পাস ও পরিচয় নিশ্চিত হলে চালান ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইয়াবা বহনকারীদের বেশিরভাগই শান স্টেট এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সক্রিয় সদস্য। মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানাগুলো এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের প্রধান উৎস হওয়ায় ইয়াবা উৎপাদন, বিতরণ ও বহনের কাজে দলের সদস্যরা সরাসরি সম্পৃক্ত। এছাড়া মগ, রাখাইনদের অনেকের কক্সবাজারে আত্মীয়-স্বজন থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ইয়াবা পাচার হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে গত বছর ইয়াবা পাচারের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে পুলিশ অফিসার, সাংবাদিকসহ অনেক নামি-দামি ব্যক্তি। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় এসব পাচারকারী আবার দ্রুত আইনের ফাঁকে ছাড়া পেয়ে যায়। কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যম্পে ইয়াবার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকও।
বর্তমানে ইয়াবা পাচার এত বেশি বেড়েছে যা রোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে খোদ প্রশাসন। জনবল আর জলযান সংকটে ইয়াবা পাচার রোধে অভিযান ব্যাহত হচ্ছে কোস্টগার্ড পূর্বজোনের। গত বছর সড়কপথে ইয়াবা পাচার বেশি হলেও চলতি বছরে পাচারকারীরা রুট পরিবর্তন করেছে। বর্তমান সময়ে ইয়াবা আসছে বেশিরভাগ নৌ পথে।
কোস্টগার্ড পূর্বজোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপটেন শহীদুল ইসলাম বলেন, ইয়াবা পাচার রোধে কোস্টগার্ড সর্বদা সজাগ রয়েছে। প্রতিনিয়ত অভিযান অব্যাহত আছে।
জনবল আর জলযান সংকটে অভিযান কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবে সীমান্তের মূল প্রবেশ পথে এর প্রতিরোধ করা গেলে পাচার অনেকটা কমে আসবে।র্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি সোহেল মাহমুদ বলেন, গত দু বছরে প্রায় এক কোটি পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব। যার সিংহভাগই সমুদ্রপথে আসা।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে জঙ্গি তৎপরতার কারণে র্যাবের জনবল সেদিকে ব্যস্ত থাকার সুযোগে পাচারকারীরা আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে র্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।