২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নারকীয় নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থার শীর্ষ প্রতিনিধিরা নিয়মিতই দেখতে আসেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প, অনুধাবন করার চেষ্টা করেন উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন। দেন নানা আশ্বাস। কিন্তু সেই আশ্বাসেই ঘুরপাক খায় দেশহীন এসব মানুষের ঘরে ফেরার স্বপ্ন।
শেষ পর্যন্ত মিয়ানামারকে রাজি করিয়ে ২০১৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা। তবে তা আর হয়নি। রোহিঙ্গাদের জুড়ে দেওয়া বিভিন্ন শর্তের কারণে তা ভেস্তে গেছে। সুযোগ পেয়ে তাদের ফেরত নিতে নানা তালবাহনা শুরু করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। দীর্ঘদিন পর চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে দেশটি। তবে আবারও শর্তের জালে প্রত্যাবাসন আটকানোর চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। তারা ফিরতে আগ্রহী, এবারও জুড়ে দিয়েছেন পাঁচটি শর্ত।
Nagad
Nagad
শুক্রবার (২১ অক্টোবর) উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা এসব শর্ত গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেছেন।
শর্তগুলো হলো—
১. রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী এবং সেজন্য তাদের নেটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে যার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে।
২. আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ‘সিটিজেন কার্ড’ দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। একই সাথে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে স্থানীয় নাগরিকের মর্যাদা দিতে হবে।
৩. রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে।
৪. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে
৫. ২০১৭ সালে সংঘটিত গণতহ্যা ও নির্যাতনের বিচার করতে হবে।
রোহিঙ্গারা বলেছেন, ক্যাম্প জীবন থেকে তারা মুক্তি চান। মিয়ানমার তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারপরও একটু শান্তির আশ্বাস পেলেই ফিরে যাবেন তারা।
টেকনাফ উনছিপ্রাং ২২নং ক্যাম্পের মাঝি রফিক বলেন, আমরা আর বাংলাদেশে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের দেশে ফিরতে চাই। আর বন্দি জীবন কাটাতে চাই না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ করেছে। এই দেশের মানুষ আমাদের যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেটি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তবে আমাদের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা বিশ্ব নেতাদের সহোযোগিতা কামনা করি।
উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের হেড মাঝি আমিন বলেন, আমাদের ৪টি দাবি পূরণ করলে আমরা দেশে ফিরবো। তার মধ্যে হল, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো। আমরা আর কাটা তারের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও তো মানুষ। আমরা বাংলাদেশে থাকতে আসেনি। আমরাও বুঝতে পারছি বাংলাদেশের অবস্থা। আমরা চীনের এই সিন্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, একজন দুজন করে নয় পরিবার নিয়ে স্বদেশে ফিরতে চান তারা। যেখানে নাগরিক হিসেবে সব অধিকার থাকবে।
উখিয়া বালুখালী ১১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা করিম উল্লাহ বলেন, আমাদের পরিবারে ১৮ জন সদস্য আছে। যেভাবে ভাসানচরে নিয়ে গেছে আমরা সেভাবে যাবো না। একবারে আমাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে মায়ানমার ফিরবো।
হাবিবউল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, আমরা দেশে ফিরতে রাজি তবে, আমাদের দাবি গুলো মেনে নিতে হবে। দেশে ফেরার আগে আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হয় আমরা আবারো নির্যাতনের শিকার হবো। আমাদের যদি জমি, জাতীয়তা না দেয় তাহলে আমরা কি আশা নিয়ে ফিরবো? তাই আমাদের আগে ৫দফা দাবি পূরণ করতে হবে।
আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবাইর বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চীনের উদ্যোগ আশা জাগানিয়া। অধিকার নিশ্চিত হলে দেশে ফিরতে প্রস্তুত তারা। তবে বর্তমান যুদ্ধের মাঝে ফেরত যাওয়া অনিরাপদ। এই মূহুর্তে মায়ানমার খুব উত্তপ্ত । এই মূহুর্তে আমাদের দেশে ফেরা পুরাপুরি অনিরাপদ।
শরনার্থী বিষয়ক কমিশন বলছে, ৮ লাখেরও বেশি তালিকা থেকে এপর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে নিজ দেশের বাসিন্দা হিসেবে বাছাই করছে মিয়ানমার।
উখিয়া কুতুপালং ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কারণে, স্থানীয়রা ফসলি জমি, শ্রম বাজার সব কিছু হারিয়েছে। যেভাবেই মাদক ও অস্ত্র পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে যদি দ্রুত প্রত্যাবাসন না হয় তাহলে স্থানীয়দের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে রোহিঙ্গারা। চীন ১১লাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার যে সিন্ধান্ত জানিয়েছেন সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।
তিনি আরও বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফিরিয়ে নিতে সম্মতি জানিয়েছে। বিষয়টি আমাদের জন্য ঈদের আনন্দের মতো হলেও কালোছায়া এখনো আমাদের ঘিরে রেখেছে। কারণ এনজিও গুলো রোহিঙ্গারা ফিরে যাক সেটি কখনো চায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নেওয়ার আগে দেশি বিদেশি এনজিও গুলোর প্রতি প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে।