মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সহিংসতা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে দেশটির নতুন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। গতকাল সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে মিয়ানমার পরিস্থিতি বিষয়ে এক প্রতিবেদন উত্থাপনের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়ীদ রা’দ আল হোসেইন এ আহ্বান জানান। এ সময় তিনি সতর্ক করে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা এত ব্যাপক যে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের হলেও এর বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। এ দেশের কক্সবাজারে দুটি শরণার্থী শিবিরে দেশটির প্রায় ৩২ হাজার শরণার্থীর বাইরে বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মিয়ানমার সরকারের কাছে স্পর্শকাতর হওয়ায় বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করে। সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশ সরকার এ দেশে শরণার্থীর বাইরে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা জানার জন্য জরিপ চালায়। তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের
আগ্রহের কথা জানাতে এ মাসের শেষ দিকে পররাষ্ট্রসচিবের নেপিডো সফরের কথা রয়েছে। এর আগে গতকাল ঢাকায় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের জন্য আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে ওই জরিপের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জুলাই মাসে কাউন্সিলের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার গতকাল সোমবার রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সম্প্রদায়ের সদস্যরা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, চলাচলে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার নেই। তাদের দিয়ে জোর করে কাজ করানো হয়। তারা যৌন সহিংসতার শিকার এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক অধিকারও নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলার চার বছর পরও প্রায় এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা ও কামান সম্প্রদায়ের মুসলমান আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা এত ব্যাপক যে তা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়ীদ রা’দ আল হোসেইন বলেন, ‘নতুন সরকার এমন একটি পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছে, যেখানে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে আইন ও নীতি রয়েছে এবং এসব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গুরুতর সহিংসতার দায়মুক্তি নতুন করে সহিংসতা চালানোতে উৎসাহিত করেছে।
তিনি বলেন, এসব বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। এটি একটি চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। মিয়ানমারের ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা ঠেকানো ও নতুন করে সহিংসতা এড়ানোই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
রোহিঙ্গা জরিপের প্রক্রিয়া রাষ্ট্রদূতদের জানাল ঢাকা : এদিকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত মিয়ানমারের নাগরিকদের জরিপের প্রক্রিয়া বিষয়ে এ দেশে নিয়োজিত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করেছে সরকার। গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশে যে অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক আছে তাদের ব্যাপারে একটি জরিপ হয়েছে। ওই জরিপের বিষয়ে আমি এবং পরিসংখ্যান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিলে তাঁদের (রাষ্ট্রদূত) অবহিত করেছি।’
রোহিঙ্গার সংখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘জরিপ করা হয়েছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যখন ফলাফল চূড়ান্ত হবে তখন এ সম্পর্কে কথা বলা হবে। আজ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁদের আমরা জানিয়েছি।’
জরিপের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এর উদ্দেশ্য বাংলাদেশে অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক কতজন আছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা করা।
এ জরিপ দিয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে কৌশল আছে, তা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে আমরা দেখব।’
পররাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, “বাংলাদেশ এখন ‘গ্লোবাল ফোরাম ফর মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের’ (জিএফএমডি) সভাপতি। ডিসেম্বরে এখানে সম্মেলনে হবে। আমরা আশা করছি যে অনেক মন্ত্রী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা আসবেন। এ ব্যাপারে এ যাবৎকালে যে অগ্রগতি হয়েছে সে অগ্রগতি সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতদের আমরা অবহিত করেছি।”