বিদেশ ডেস্ক : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত গোপন সমঝোতার খসড়া ফাঁস হয়ে গেছে। এটি এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া চুক্তির খসড়ার যথার্থতা নিশ্চিত করেছে। তারা ওই নথি পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, খসড়া চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি মেলেনি। উপেক্ষিত হয়েছে তাদের নাগরিকত্বের দাবি। জাতিসংঘ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নীতির আওতায় গোপনীয় বিষয় ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন মিয়ানমারের সেনাশাসিত জান্তা সরকার এক আইনের বলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে চিহ্নিত করে চালানো হয় কাঠামোবদ্ধ সেনা প্রচারণা। ধাপে ধাপে সেখানকার মানুষদের মাঝে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তোলা হয়। সর্বশেষ গত বছর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে সহিংসতা জোরালো করলে বাংলাদেশ পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপে এসব রোহিঙ্গাকে ফেরাতে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি। এমন বাস্তবতায়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত মে মাসের শেষ নাগাদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
চুক্তির বিস্তারিত এখনও প্রকাশিত না হলেও তা ইতোমধ্যেই অনলাইনে ফাঁস হয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, তারা দুইটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থার সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে এটিই মিয়ানমার-জাতিসংঘ সমঝোতার খসড়া। ওই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের একদিন আগে খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়। তবে তার আগেই এর মূল ভাষ্য রচিত হয়েছিল কূটনীতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য দেওয়া জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশনের ব্রিফিং-এ। সেই নথিও রয়টার্সের হাতে এসেছে। প্রত্যাবাসন প্রশ্নে শরণার্থী কমিশনের একটি চিঠির অনুলিপিও পেয়েছে রয়টার্স।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের মধ্যকার সমঝোতা স্মারকটির(এমওইউ) অনুলিপি পর্যালোচনার পর রয়টার্স জানিয়েছে, সই হওয়া গোপন চুক্তিতে দেশটিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা সারা দেশে স্বাধীনভাবে চলাচলের কোনো প্রকাশ্য নিশ্চয়তা নেই। শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সমঝোতা স্মারককে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা কী হবে তাও স্পষ্ট নয়। প্রত্যাবর্তনকারী সবাইকে যথাযথ পরিচয়পত্রের কাগজ ও তারা যাতে স্বেচ্ছায় মুক্তভাবে ফিরতে পারেন, মিয়ানমার সরকারকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, রাখাইনে অন্যান্য অধিবাসীদের মতোই প্রচলিত আইন মেনে স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার ভোগ করবেন ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা। তবে রাখাইন রাজ্যের সীমানার বাইরেও তারা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে কিনা, সেই নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এমনকি বর্তমানে যে আইন ও নীতিমালা দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার অধিকার রোধ করা হয়েছে, তা সংশোধনের প্রতিশ্রুতিও সেখানে নেই। রয়টার্সের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানেও নিশ্চিত করা হয়েছে, ৮২ সালে প্রণীত যে নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে, তা পর্যালোচনার কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেপিডোর নেই।
মিয়ানমারে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক লরা হাই বলেন, যখন বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরছেন, তখন তার অর্থ হচ্ছে, তারা এমন একটি বর্ণবিদ্বেষমূলক রাজ্যে ফিরছেন, যেখানে তারা মুক্তভাবে চলাফের করতে পারবেন না। এমনকি তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও কর্মস্থলে যাতায়াতের সুযোগ থাকবে না।
জাতিসংঘ ফাঁস হওয়া নথির ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সংস্থাটির এক মুখপাত্র বলেছেন, তাদের নীতি হচ্ছে, ফাঁস হওয়া নথি নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা।ইমেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সমঝোতার মূল আলোচ্যবিষয় প্রকাশের ব্যাপারে ইউএনডিপি, ইউএনএইচসিআর ও মিয়ানমার সরকার আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।