উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা মাদক ইয়াবার ভয়ানক আগ্রাসন রোধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার পরও এই মাদক সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা থামছে না। টেকনাফের নাফ নদীতে রাতের বেলা সাময়িকভাবে মাছ শিকার বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর ইয়াবার চোরাচালান হ্রাস পেয়েছে সত্য, কিন্তু থেমে নেই মাদক ব্যবসায়ী চক্র। গত সপ্তাহে ছোট বড় বেশ কয়েকটি ইয়াবার চালান আটক হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছে চোরাচালানি চক্রের কয়েক ক্যারিয়ার। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইয়াবার আগ্রাসন রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান করার আইনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাঝে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু থেমে নেই। এ অবস্থায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আগামী ২০ ও ২১ আগস্ট দুদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে এ বৈঠক হবে বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে শনিবার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সংস্থা সিসিডিএসি’র সঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটি হবে দ্বিতীয় বৈঠক। এর আগে ২০১৫ সালে ঢাকায় প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আইনের খসড়া প্রণীত হয়েছে। এ খসড়া নিয়ে ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্যও প্রায় ৪৫টি সরকারী বেসরকারী সংস্থার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। মিয়ানমারে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের আগে এ সংক্রান্ত সুপারিশ চূড়ান্ত হবে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে। এরপর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হবে। পরবর্তীতে তা আইনী বৈধতার জন্য চূড়ান্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, ইয়াবার আগ্রাসন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত এ মাদকের বেচাকেনার হাটে পরিণত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। মাদক চক্রের হোতারা এ ব্যবসার মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলতে গিয়ে দেশের যুব সমাজকে নিশ্চিতভাবে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায় দুই দশক ধরে ইয়াবার আগ্রাসন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এরপরই তিনি প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে নাফ নদীতে রাতের বেলায় মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন, যা গত মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থা সাময়িক। যেহেতু এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে নাফ নদীতে মৎস্যজীবীদের জীবন জীবিকা নির্বাহে একটি বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, সেক্ষেত্রে আইনী কাঠামো নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যা যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে ২শ’ গ্রাম থেকে তদূর্ধ ইয়াবা পরিবহনের জন্য মৃত্যুদ- এবং এর নিচে হলে ১ থেকে ৫ বছর সশ্রম কারাদ-ের সুপারিশ করা হয়েছে। এ আইনের সঙ্গে সিসা জাতীয় মাদকও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত ইতিবাচক ও সময়োপযোগী বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি দলের ঢাকায় তখন অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এ নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোন সাড়া মিলেনি। বাংলাদেশের পক্ষে সে দেশের সীমান্ত এলাকার কোন কোন স্থানে ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তারও একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এসব কারখানা থেকে ইয়াবা উৎপাদন বন্ধে কোনরূপ উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষে এমনও বলা হয়েছে, ইয়াবা মরণ ছোবল শুধু বাংলাদেশ নয়, আগামীতে সে দেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় যে ডেকে আনবে তা নিশ্চিত। ২০১৫ সালের পর থেকে এ বিষয়ে নানাভাবে দুদেশের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু সুফল আসেনি। বিলম্বে হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সাড়া মিলেছে এবং আগামী ২০-২১ আগস্ট ইয়াঙ্গুনে দুদেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করা হয়েছে।
এদিকে, তিনমাসের আল্টিমেটাম দিয়ে ইয়াবা পাচার রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। এই সময়ের মধ্যে কক্সবাজার দিয়ে ইয়াবা পাচার অর্ধেকে নামিয়ে আনার টার্গেট নেয়া হয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ইয়াবা চোরাচালান সিন্ডিকেটের ৫০ সদস্যের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হচ্ছে বলেও জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে।
৫০ শীর্ষ ইয়াবা চোরাকারবারির যে তালিকা হয়েছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও কক্সবাজার অঞ্চলের চোরাকারবারিদের নাম রয়েছে। পুলিশ এদের নাম গোপন রাখলেও সাধারণ মানুষের কাছে এদের পরিচয় কারও অজানা নয়। এ তালিকায় সরকার দলীয় এবং বিরোধীদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনের নামও রয়েছে।
অপরদিকে, নাফ নদীতে রাতের বেলা মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণার পর পৃথক অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি টাকার ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে মিয়ানমারের ১০ নাগরিক। এরা সকলেই রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য। মূলত এরা ক্যারিয়ার হিসাবেই এ কাজে নিয়োজিত। গডফাদাররা রয়েছে আড়ালে আবডালে। গত বৃহস্পতিবার কোস্টগার্ড সদস্যরা টেকনাফের সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ পিস ইয়াবা ও ট্রলারসহ ৬ মিয়ানমার নাগরিককে আটক করে। ইয়াবাবাহী একটি ট্রলার আটক করতে ৩ রাউন্ড ফাঁকাগুলিও বর্ষণ করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। আটকের পর ট্রলার অভ্যন্তরে তল্লাশি চালানোর পর বেরিয়ে আসে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ পিস ইয়াবা। কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার জাফর আলম সজীব জনকণ্ঠকে জানান, এই অভিযানে আটককৃতরা হচ্ছে মংডু থানার মেয়রকূল পাড়ার নাজির আহমদ, রহিম উল্লাহ, মোঃ করিম, এনামুল হোসেন, মোঃ রফিক ও মোঃ ফারুক। এরা সকলেই রোহিঙ্গা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এই চালানের গডফাদার চট্টগ্রামে থাকেন। কিন্তু নাম জানে না। কোস্টগার্ড সূত্রে জানানো হয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের পণ্যের আড়ালে টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে এসে থাকে মাদক ইয়াবার চালান। এছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টের বিজিবি জওয়ানরা সীমান্ত বাণিজ্যের পণ্য বোঝাই ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে ১৯ হাজার ৬৯০ পিস ইয়াবা উদ্ধার ও ট্রাক চালককে আটক করেছে। ইয়াবা বোঝাই ট্রাকটি টেকনাফ স্থল বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে আসছিল। এ ঘটনায় ট্রাক চালক মঞ্জুর আলমকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় টেকনাফের বাহারছড়া দুই সহোদর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইয়াবাবিরোধী সরকারী কঠোর অবস্থান লক্ষ্যণীয় হওয়ার পর জেলা পুলিশ বিভিন্ন স্থানের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ইতোমধ্যে বৈঠক করেছে। জেলা পুলিশ সুপার ড.একেএম ইকবাল হোসাইন ইয়াবা বিরোধী অভিযানে কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রকাশ্যে যখন বলেছেন, ‘ইয়াবা এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। দেশকে ইয়াবা মুক্ত করা না গেলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’ এমন বক্তব্যের পর কক্সবাজার অঞ্চলের পুলিশ ইতোপূর্বেকার চেয়ে তাদের ইয়াবাবিরোধী তৎপরতা জিরো টলারেন্সে নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ইয়াবার অবৈধ ব্যবসায় রাতারাতি বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলা যায়-এমন লোভের বশবর্তী হয়ে চোরকারবারীদের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ সংযুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন এনজিও সংস্থার যানবাহন, রোগী বহনের এ্যাম্বুলেন্সযোগেও ইয়াবার চালান গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। লাশ বহনের গাড়িতে ইয়াবার চালান উখিয়ায় ধরা পড়ার পর এ নিয়ে বড় ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। এর আগেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কর্মরত হল্যান্ডভিত্তিক একটি এনজিও সংস্থার এ্যাম্বুলেন্স থেকে ৫৫ হাজার পিস ইয়াবা আটক হয়। এ সময় গ্রেফতার হয় এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার সফিউল আলম ও নার্স শিখা রানী। জহির-জামাল নামের ইয়াবা পাচার সিন্ডিকেট দিনের পর দিন চালিয়েছে ইয়াবার চোরাচালান। ইতোমধ্যে জহির ও জামাল গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছে। এর পাশাপাশি জামালের ছোট বোন মোহসেনা বেগম ও স্বামী জুয়েলও গ্রেফতার হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে এ ধরনের বহু সিন্ডিকেট গজিয়ে উঠেছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়েতে অবস্থানরত সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদের মোবাইল ফোনে রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। সাধারণত, রোহিঙ্গাদের ক্যারিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অশিক্ষিত ও দরিদ্র শ্রেণীর রোহিঙ্গা নরনারীরা এ কাজে জড়িয়েছে অর্থাভাবে। একটি চালান গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলেই চলে আসে পকেট ভর্তি টাকা। বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলতে চোরাচালানকারীরা এ কাজে যেমন তৎপর, তেমনি এদেশে শরণার্থী ও আশ্রিত হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য অবৈধ ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে অহরহ যুক্ত হচ্ছে।
– সুত্র : জনকন্ঠ
পাঠকের মতামত