কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তে কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার থেকে যখন গোলা ও মর্টার শেল এসে পড়ছে, এমনকি স্থলমাইনে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যুও হলো- তখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোসহ মূল সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া কূটনৈতিক ফ্রন্টে কোনো নতুন পদক্ষেপের খবরও পাওয়া যায়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত পৃথিবীতে পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলেও নয়। নিকটতম প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদেশ ভারত, মুক্তিযুদ্ধের অপর সহায়ক দেশ পরিবর্তিত রাশিয়া এবং নতুনভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কে জড়ানো চীন- যারা মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে- সেই তিনটি দেশেরই কৌশলগত অগ্রাধিকার মিয়ানমারের পক্ষে। বাংলাদেশ সেখানে কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর রোহিঙ্গা সংকটে জড়িয়ে গেছে ঢাকা। এখন ১২ লাখের বেশি শরণার্থী দুঃসহ বোঝা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর পর থেকেই ঢাকা দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয়- সব ফোরামে সংকট সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সবাই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নিলেও চীন ও রাশিয়া এক প্রকার মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক মহলে বাঁচিয়ে চলছে। আর ভারতকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। মিয়ানমারের ইস্যুটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে গেলেও রাশিয়া ও চীন বরাবরই ভেটো দিয়ে এসেছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সব পক্ষকে রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড় করাতে পারা বাংলাদেশের জন্য সীমাবদ্ধতা বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। সমকালকে তিনি বলেন, বিষয়টিতে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
এখানে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক স্বার্থ অনুধাবন করতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ, এ দেশগুলো নিজ কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক স্বার্থের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে না।
কূটনীতিকদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে সব দেশই যার যার নিজের স্বার্থ দেখে। এখানে ভারত, রাশিয়া ও চীনও নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ দেখছে। মিয়ানমারের অং সাং সু চির সময়ে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নেপিদোতে সফরে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই চীন উদ্বিগ্ন। চীন দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারকে কৌশলগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। চীনের দুটি পাইপলাইনসহ মিয়ানমারে হাজারো কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। আর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের অন্যতম পথ হিসেবে মিয়ানমারকে বিবেচনা করে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল নিয়ে সামনে এসেছে, চীনের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে।
রাশিয়া মিয়ানমারকে বর্তমানে ব্যবসায়িক দিক থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে বলে ঢাকায় রাশিয়ার এক কূটনীতিক সমকালকে বলেন। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, মূলত চীনের কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রাশিয়ার গভীর। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির সঙ্গে সামরিক সরঞ্জামের ব্যবসা রয়েছে মস্কোর। আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর কয়েকটি দেশ রয়েছে, যারা রাশিয়ার পাশে। এর মধ্যে মিয়ানমারকে দূরে ঠেলে রাশিয়া ব্যবসা ও বন্ধু কোনোটাই হারাতে চায় না।
তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে ওই কূটনীতিক বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয়, আর মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও যাবে না।
এদিকে ভারতের কৌশলগত অগ্রাধিকার নিয়ে এক কূটনীতিক বলেন, ভারত নব্বই দশকের শুরু থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে আসছে। সে সময়ে রেঙ্গুন-কালাদান হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন করত দেশটি। কালাদান প্রকল্প ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বিভিন্ন কারণে পিছিয়েছে। মিয়ানমার হয়ে কানেক্টিভিটি ও দেশটির সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ভারতের জন্য জরুরি। আর সে সঙ্গে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় তো রয়েছেই।
মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্কের গভীরতার বিপরীতে বাংলাদেশের জন্য কি দরজা খোলা রয়েছে- এ প্রশ্ন রেখেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। সমকালকে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের হিসেবে ভারতকে দেখছি। কারণ তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য। তারা বিষয়টি সেখানে উপস্থাপন করতে পারে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়েও তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। এখন ভারত কতটুকু করতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এরপর বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে চীনকে অনুরোধ করার। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ কথা বলতে পারে।
তিনি বলেন, মিয়ানমার কূটনীতির ভাষা বোঝে না। তারা বোঝে শক্তির ভাষা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে মিয়ানমার। একাধিকবার আকাশসীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের ভূমিতে মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে। এখন তো এ প্রমাণও পাওয়া গেছে যে, সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশে এসে মাইন পুঁতে গেছে। ফলে গত শুক্রবার বাংলাদেশি একজন আহত হয়ে পা হারিয়েছেন। এতদিন শুধু নিজ দেশের আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল দেশটি। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর চড়াও হচ্ছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মিয়ানমারের আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি বাংলাদেশ দুর্ঘটনা হিসেবে দেখে আসছিল। কারণ সীমান্ত সরল রেখায় নেই, আঁকাবাঁকা। ফলে আকাশসীমা লঙ্ঘন হয়েছে। মর্টার শেল বা গোলা ছোড়ার বিষয়টিও দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছিল। ভুল করে হয়তো দু'একটা এসে পড়েছে। কিন্তু একই ভুল যখন বারবার হয়, তখন সেটিকে আমলে নিতে হয়। আর বাংলাদেশের ভেতরে যখন মাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি আসে, তখন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে মিয়ানমারের একের পর এক মর্টার শেল পড়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারের মর্টার শেল পড়া এবং একজনের মৃত্যু ও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে উদ্বেগ জানায়। সাধারণ নাগরিকের জীবন অবশ্যই সুরক্ষিত হতে হবে। আরও সহিংসতা ও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাতে না যায়, সেজন্য জাতিসংঘ শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিয়ানমারের বিষয়টি জাতিসংঘ পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল।