‘আমি কারাগারে ছিলাম। ৩১ বছর জেল খাটছি। আমি অপরাধ করেছি, অপরাধের সাজা খাটছি। এখন ভালোভাবে চলবো। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশাবাদী। আমার বাড়ি নেই, ঘর নেই। আমার বয়স এখন ৭৪ বছর। আমাকে যেন একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আমাকে যেন একটা বাড়ি দেয়।’
রবিবার (১৮ জুন) কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এসব কথা বলছিলেন জল্লাদদের সর্দার শাজাহান ভুঁইয়া। মোট ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগ করে জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি অতীতে যত অপরাধ করেছি, সে জন্য সাজা খেটেছি। এখন আমি পরিশুদ্ধ হয়েছি। বাকি জীবনটা ভালোভাবে কাটাতে চাই।’
কারা সূত্র জানায়, হত্যা ও অস্ত্র মামলায় শাজাহান ভুঁইয়ার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হিসেবে তাকে ফাঁসি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি ফাঁসি কার্যকরের জন্য তিনি দুই মাসের কারাদণ্ড মওকুফ পেয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য কারণে তার সাজার মেয়াদ কমিয়ে ৩২ বছর করা হয়েছিল।
শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি কারাগারে ভালোই ছিলাম। কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে, আদর করেছে। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জল্লাদের কাজ দিয়েছিল। আমি সাহসী ছিলাম বলেই এ কাজ পেয়েছিলাম। আমি চলে এসেছি, এ কাজ এখন অন্যরা করবেন। অনেক আলোচিত মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসি কার্যকরে কাজ করেছি।’
কারা সূত্র জানায়, শাজাহান ভুঁইয়া ২৬ জন আসামির ফাঁসি সম্পন্ন করতে প্রধান জল্লাদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নব্বই দশকের আলোচিত শারমীন রিমা হত্যার প্রধান আসামি মুনীর, খুলনার আলোচিত ব্যক্তি এরশাদ শিকদার, শীর্ষ জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের ফাঁসি কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
শাজাহান ভুঁইয়া বলেন, ‘আমি তো মানুষ। একটা মানুষের প্রাণ আমার হাত দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমার আবেগ কাজ করতো। কিন্তু আবেগ দিয়ে তো কিছু হবে না। আমি না করলে অন্য কাউকে তো করতেই হতো। আর আমি তো নিজের ইচ্ছায় কাউকে মারছি না। আদালতের রায়ে তাদের ফাঁসি হয়েছে। রাষ্ট্র তাদের ফাঁসি দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষার সুযোগও পেয়েছিল। এখানে আমার কিছু করার নেই।’
শাজাহান বলেন, ‘বাইরে যতই প্রভাব বা উচ্ছৃঙ্খল থাকুক না কেন, ফাঁসির আগে সবাই শান্ত ছিল। যখন একজন মানুষ জানতে পারে যে সেদিনই তার জীবনের শেষ দিন, তখন আর তার কোনও কিছু করার থাকে না। রীমার স্বামী মুনীর ফাঁসির আগে একটা সিগারেট চেয়েছিল। আর এরশাদ শিকদার বলেছিল—তিনি কোনও অন্যায় করেননি।’
কারা নথি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শাজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিও ছিলেন। একপর্যায়ে অন্ধকার জীবন বেছে নেন তিনি। ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির জন্য ১২ বছর এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অপর একটি ডাকাতি ও হত্যার মামলায় ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয় তার। এ ছাড়া উভয় রায়ে তাকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার একটা বোন আর ভাগনে আছে বলে জানি। কিন্তু জেলে আসার পর তাদের কারও সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি। জেলে থাকা অবস্থায় দুই-একবার ফোনে কথা হয়েছে। এখন আমি আমার সহযোগীর বাসায় যাচ্ছি। তারা জেলে আমার সঙ্গে ছিল। আমার তো কেউ নেই।’