ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পবিত্র মক্কা নগরীতে। নবুওয়াতের পঞ্চম বা ষষ্ঠ বছরে প্রায় ২৬ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের শক্তিশালী করেছিল। তিনিই সর্বপ্রথম ‘আমীরুল মু‘মিনীন’ উপাধি পেয়েছিলেন।
হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ইন্তেকালের পর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১০ বছর ৬ মাস অর্ধ পৃথিবী শাসনের পর ২৩ হিজরীর জিলহজ মাসে আবু লু’লু’ নামে এক অগ্নিপূজকের বর্শার আঘাতে শাহাদত বরণ করেন।
মৃত্যুসজ্জায় তিনি রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও পরিবারের করণীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন- পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘অবশ্যই নামাজ পড়তে হবে’
হজরত মিসওয়ার বিন মাখরামাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্শার আঘাতে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর একদিন ভোরবেলায় আমি ও হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমীরুল মু‘মিনীনকে দেখতে গেলাম। তিনি মৃত্যুসজ্জায় শায়িত। তখনও ফজরের নামাজ পড়েননি।
আমরা বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! নামাজ, নামাজ। তিনি বললেন, অবশ্যই নামাজ পড়তে হবে। যে নামাজ ছেড়ে দেয়, ইসলামে তার কোন অংশ নেই। এ কথা বলেই তিনি নামাজ পড়তে শুরু করলেন। এসময় তার আঘাতের স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল।
দুনিয়াকে বিদায় জানানোর মূহুর্তে ওমর ফারুক রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই উপদেশ ছিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসিয়তের অনুকরণ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরকালের সফর শুরুর আগে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং অবস্থা এমন ছিলো যে, হুশ ফিরে আসতো, আবার অচেতন হয়ে যেতেন। তখন তিনি জানতে চাইতেন, লোকজন নামাজ পড়েছে কিনা। তিনি বলতেন,
الصَّلاة الصَّلاة وما ملكت أيمانكم
— নামাজ, নামাজ (অর্থাৎ কারও যেন নামাজ ছুটে না যায়)। এবং দাস— দাসীদের প্রতি খেয়াল রাখো।
যারা সামান্য অজুহাতে নামাজ ছেড়ে দেয় বা নামাজই পড়ে না তাদের জন্যে হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর জীবনের শেষ মুহুর্তে আহত অবস্থায় নামাজ আদায়ের ঘটনায় শিক্ষা-উপকরণ রয়েছে।
অল্প বয়সেই জ্ঞান শিক্ষা
মৃত্যুসজ্জায় হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেছেন,
تفقَّهوا قبل أن تسوَّدوا
— তোমরা নেতা হওয়ার আগেই ফেকাহ (জ্ঞান) শেখো।
ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই কথার মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন, নেতৃত্ব মূলত ইলম (জ্ঞান) শেখার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। নেতৃত্বের অহংকার এবং নেতা হওয়ার লাজুকতা নেতাদেরকে শিক্ষার্থী হতে বাঁধা দেয়। এই কারণে হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, তোমরা নেতা হওয়ার আগেই ইলম (জ্ঞান) শিক্ষা করো।
ইমাম শাফী রহ. বলেন, ‘যখন অল্প বয়স পেরিয়ে যায়, তখন তার থেকে অনেক ইলম ছুটে যায়’।
ইমাম আবু উবায়েদ রহ.- এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তোমরা নেতা হওয়ার আগে, শৈশবেই ইলম শিখে ফেলো। কারণ, নেতা হওয়ার পর অহংকার তাকে ছোটদের কাছ থেকে ইলম শিখতে বাঁধা প্রদান করে। ফলে সে গণ্ড মূর্খই থেকে যায়’।
‘প্রতিযোগিতা ও সর্বশক্তি দিয়ে আমল কর’
ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আরও বলেন, সব কাজে ধীরস্থিরতা উত্তম, তবে পরকালের কাজ ছাড়া। কারণ, মানুষ জানে না কখন তার মৃত্যুর ঘণ্টা বেঁজে ওঠবে। তাই দেরি না করে প্রতিযোগিতা ও সর্বশক্তি ব্যয় করে আমল করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
— তোমরা কল্যাণের কাজে দৌড়ে আসো। -(সুরা বাকারাহ: আয়াত: ১৪৮)
আয়াতের চাহিদাও হলো, ভালো ও কল্যাণকর কাজে ধীরস্থিরতা নয়, বরং জলদি করা।
নিজের আমলের হিসাব
এর সাথে সাথে নিজের আমলের হিসাব নেয়া। ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন,
حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا؛ فإنَّ أهون عليكم في الحساب غدًا أن تحاسبوا أنفسكم، وتزيَّنوا للعرض الأكبر، يوم تعرضون لا تخفى منكم خافيةٌ
— তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গ্রহণ করার আগে, তোমরা তোমাদের হিসাব কষে নাও। তোমাদের আমল মাপার আগে, তোমরা নিজেরা নিজেদের আমল মেপে নাও। কারণ, এটি তোমাদের হিসাবের জন্য সহজ হবে, আগামীকাল তোমাদের থেকে হিসাব গ্রহণ করার থেকে। এবং যেদিন তোমাদের কাছে সবকিছু প্রকাশ হয়ে যাবে, সেদিন তোমাদের আমল মাপার আগে, তোমরা নিজেরা মেপে নিলে তোমাদের জন্যে সহজ হবে।
সূত্র: মাওয়ায়েজে সাহাবা
মুযযাম্মিল হক উমায়ের, অতিথি লেখক