॥ এম.এ আজিজ রাসেল ॥
ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ি জীবনধারার সাথে সখ্যতা সৃষ্টির ইচ্ছা ছিল। উঁচু টিলা, সবুজ বন, পাহাড়ের খাঁজ কেটে কেটে জুম চাষ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির টান আমার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে অনেকবার। এবার আবারও সুযোগ হলো পাহাড়ে যাওয়ার। সুযোগ হলো পাহাড়ের কোলে বাস করা সেই সব মানুষদের কাছ থেকে একেবারে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে যাওয়ার। বরণডালাটা ছিল আমাদের ইচ্ছামতোই সাজানো, ঠিক যেমন আমরা চেয়েছিলাম। দিনপঞ্জি দেখে হিসাব-নিকাশ করে তবেই যে রওনা দেওয়া দিব।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী থেকে কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমাদের কক্সবাজার পরিবার এর পক্ষ থেকে বার্ষিক বনভোজন করার জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। মার্চের শুরুতেই ৪ মার্চ রবিবার ঠিক করা হয় বাংলাদেশের দার্জিলিং খ্যাত পাহাড়ি কন্যা বান্দরবানে বসবে এবারের দৈনিক আমাদের কক্সবাজার পরিবারের মিলনমেলা। পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আরটিভির জেলা প্রতিনিধি সাইফুর রহীম শাহীন এর দিক নির্দেশনায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু করে বান্দরবান যাওয়ার প্রস্তুতি। পত্রিকার জেনারেল ম্যানেজার শহিদুল করিম শহিদ এর তত্ত্বাবধানে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অবশেষে দরজায় কড়া নাড়ে ৪ মার্চ। অফিসের সবাই সকাল ৮টার মধ্যে চলে আসে কক্সবজার শহরের গ্রীণ ভ্যালি কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে। আগে থেকেই সবার জন্য অপেক্ষা করছিল গাড়ি। সকাল ৯টায় সবাই এসে হাজির। এবার রওনা দেয়ার পালা। গাড়ি ছাড়ল ঠিক সাড়ে ৯টায়। সাথে অতিথি হিসেবে যোগ দিল সাংবাদিক জসিম উদ্দিন ছিদ্দিকী ও পত্রিকা ছাপার কারিগর লাবলু বেপারী। গাড়ির স্পীড বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ প্রতিবেদক শাহাদাত হোছাইনের নেতৃত্বে বেড়ে যায় সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা। সাথে গান আর কৌতুকে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেন নির্বাহী সম্পাদক ও মোহনা টেলিভিশনের কক্সবাজার প্রতিনিধি আমানুল হক বাবুল, চীফ রিপোর্টার আতিকুর মানিক ও উপকূলীয় প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম হাবিব। লিংক রোড থেকে আমাদের সাথে যোগ দেন টেকনাফস্থ নিজস্ব প্রতিবেদক কাইছার পারভেজ চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর আলম। রামু বাইপাসে গাড়ী থামিয়ে তোলা হয় প্রতিনিধি আবদুল মালেক সিকদারকে। আর চিরিঙ্গা থেকে সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে যোগ দেন চকরিয়ারস্থ বিশেষ প্রতিবেদক জহিরুল আলম সাগর। পরিবারের সদস্য বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে যায় কোলাহল। গাড়িতেই মাইক্রোন হাতে পেয়ে যে যার মতো শিল্পীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সাতকানিয়া রাস্তার মাথায় যখন আমাদের বহনকারী ‘পূরবী’ বাসটি পৌঁছায় তখন সবাই আরেকবার উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। সবার লক্ষ্য বান্দরবানের পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। গাড়ি চলতে শুরু করলো বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। উঁচু-নিচু রাস্তা মিলে গেছে পাহাড়ের সাথে। খুব কাছ থেকে যেন সবাইকে ডাকছে প্রকৃতির রাণী। যতোই দেখি আমরা বিমোহিত হয়েছি। এখানে রাস্তায় কোথাও ভাঙ্গা নেই। ঘড়ির কাটা যখন ১টার দিকে তখন আমরা পৌঁছলাম কাঙ্খিত স্থানে। কক্সবজাার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতায় আমাদের ঠাঁই হয় মেঘালয় পর্যটন কমপ্লেক্সের রেস্ট হাউসে। পত্রিকার পক্ষ থেকে দুই জেলা প্রশাসন বিশেষ করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট খালেদ মাহমুদ এর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। সাথে কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা পরিষদ কর্মকর্তা মো: আলাউদ্দিন এর প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি আন্তরিকভাবে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
যাক, রেস্ট হাউসে ফ্রেশ হওয়ার পর বের হয়ে দেখি চারদিকে পাহাড়। মাঝখানে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা লেক। আর লেকের উপর দুইটি ঝুলন্ত ব্রীজ। সেখানে রাখা হয়েছে ক্যাবল কার। হরিণ, চিতা বাঘ, বানর, ভাল্লুকসহ নানা প্রাণীদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও এখানকার প্রশাসন বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলো সাজিয়েছেন নান্দনিকভাবে। পাহাড়কে কাজে লাগিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চোখ ধাধানো পর্যটনের রূপ। আসলে সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে বান্দরবানকে সাজিয়েছেন। দুপুরের খাবার শেষে একটি খোলা পিকআপ নিয়ে সবাই রওয়ানা হলাম স্বর্ণ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি মন্দিরের অবকাঠামো আগের তুলনায় অনেক উন্নত করা হয়েছে। নানা রঙ ও শৈল্পিক কারুকার্যে সাজানো হয়েছে মন্দিরকে। স্বর্ণ মন্দির অবলোকন শেষে গাড়ি চলল নীলাচলের পথে। চলার পথে আমার নেতৃত্বে বেশ জমে উঠে নানা শ্লোগান ও ডায়লগ। যা উৎসুক জনতার নজরকাড়ে। গত ১০ বছরে বদলে গেছে বান্দরবান শহরের চেহারা। এখানকার পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত। রাস্তায় নেই কোন আবর্জনা। জরাজীর্ণ বা ভাঙা রাস্তার সাথে মনে হয় শহরের মানুষ পরিচিত নয়। পুরো শহরজুড়ে রয়েছে উন্নয়নের চাপ। নীলাচল পৌঁছে সকলের চোখ তাক লেগে যায়। উঁচু পাহাড়ের পিঠ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘমালাকে। দুর-দিগন্তে মিশে গেছে পাহাড়ি জনপদ। এখান থেকে পুরো বান্দরবান শহর এক নজরে দেখা যায়। রামু প্রতিনিধি আবদুল মালেক সিকদার পাঁচ শতাধিক ছবি তুলেছেন এখানে। নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে সবাইকে হাফিয়ে তুলেছেন তিনি। পাশাপাশি সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল ছবি তুলতে। কারণ ছবিইতো মানুষের নানা স্মৃতি বহন করে। মনে করে দেয় পুরনো দিনের কথা। সন্ধ্যাটা এখানেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। তারপর যাত্রা মেঘালয়ে। নাস্তা খাওয়ার পর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা ও র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠান দৈনিক আমাদের কক্সবাজার পরিবারের মিলনমেলা। পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুর রহিম শাহীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। অতিথি সাংবাদিক জসিম উদ্দিন সিদ্দিকীর পরিচালনায় অনুষ্টানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নির্বাহী সম্পাদক আমানুল হক বাবুল। পরে বিশেষ প্রতিবেদক শাহাদাত হোছাইন ও জিএম শহিদুল করিম শহিদকে সাথে নিয়ে আমি হৈই-হুল্লোড়ভাবে জমিয়ে তুলি র্যাফেল ড্র। সবাই মেতে উঠে আনন্দ-গানে। রাতের খাবার শেষে সবাই নব স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন ৫ মার্চ সোমবার। খুব ভোর থেকে আবদুল মালেক সিকদার, জহিরুল আলম সাগর, নিজস্ব প্রতিবেদক হোবাইব সজীব (কেসি), মহেশখালী প্রতিনিধি আবু তাহের ও লাভলু বেপারী ঘুম থেকে উঠে যান। রুমের কড়া নেড়ে অন্যদেরও ঘুম থেকে তুলে দেন। আমি শাহাদাত ও শহিদ ভাই ফ্রেশ হয়ে দেখি সবাই লেকে নৌ-ভ্রমণে ব্যস্ত। আর মালেক সিকদার ব্যস্ত ছবি তুলতে। বেলা গড়াতেই হাজারো পর্যটকের সরব পদচারণায় মেতে উঠে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়তে শুরু করল। ১১টার দিকে মেঘলা ক্যাফে নামের একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে সবাই বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। বান্দরবানের জন্য আমি পুরোনো হওয়ায় রাস্তাঘাট চিনতে কষ্ট হয়নি। একে একে বান্দরবান সরকারি কলেজ, বোমেরাং রাজার প্রাসাদ, রাজার মাঠ, নতুন ব্রীজ, গুরু ভান্তেসহ একাধিক মন্দির দর্শন শেষে দুপুরে সেই ক্যাফেতে লাঞ্চ সারলাম। পরে সবার অংশগ্রহণে জমে উঠে চা আড্ডা। ততক্ষণে ধীরে ধীরে সূর্যটাও পশ্চিমা আকাশে হেলে পড়তে শুরু করেছে। তার মধ্যে চমকপ্রদ ঘোষণা সম্পাদকের। আগামী বছরের দৈনিক আমাদের কক্সবাজার পরিবারের পিকনিক হবে বার আউলিয়ার দেশ, বাংলার লন্ডনখ্যাত সিলেটে। এই ঘোষণায় সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠে। এরই মধ্যে নীড়ে ফেরার জন্য হাজির সেই পূরবী বাস। বাস যতোই নীড়ের উদ্দেশ্যে ফেরে, ততোই সবার চোখ ঝিমিয়ে যায়। আর মনের মাঝে সবাই বুনে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। জেগে উঠে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার দেখার প্রবল ইচ্ছা শক্তি।
লেখক ঃ মফস্বল বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।