বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের তীর ধরে নির্মিত কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের উদ্বোধন শনিবার। সড়কটি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থারও নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। ২৬ বছর আগে বিএনপি আমলে শুরু করা এ সড়ক প্রকল্পটি বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের হাতে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। এটি দেশের উন্নয়নের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ও ইতিবাচক মেলবন্ধন। আমি আশা করি, দেশের প্রয়োজনে অন্যের ভালো কাজগুলো আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করব আশার আলো।
আজ আমি তুলে ধরতে চাই মেরিন ড্রাইভ নিয়ে এক অকথিত ইতিহাস। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার কিছুদিন পর কক্সবাজার সফরে আসেন। তিনি দিনে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচী সেরে রাতের বেলায় বের হন সমুদ্র সৈকত দেখতে। সাথে যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল অলি, বন মন্ত্রী নোমান, আমি (তখন কক্সবাজার জেলার বিএনপি দলীয় একমাত্র এমপি আমি) প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সালাহউদ্দিন আহমদসহ সরকারী কর্মকর্তারা তাঁর সাথে ছিলাম। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। সেসময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কোন সড়ক ছিল না। সৈকতের লাবণী পয়েন্ট ছিল একটি কোন রকমে চলনসই সড়ক। এছাড়া প্রবাল মোড় থেকে পরমাণু শক্তি কমিশন কেন্দ্র পর্যন্ত একটা ভাঙ্গা রাস্তা ছিল, যেখানে গাড়ী চলাচল করা ছিল কঠিন। এরপরে কোন রাস্তা ছিল না, যেখানে রিক্সা বা গাড়ী চলাচল করা যায়। তবে সমুদ্র সৈকত ধরে পানির কাছাকাছি ভেজা বালিতে গাড়ী চালানো যেত। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষ সৈকত দিয়ে জীপে চড়ে (নিয়মিত সার্ভিসও ছিল না) বা পায়ে হেঁটে শহরে যাতায়াত করত। তা সম্পূর্ণই নির্ভরশীল ছিল সমুদ্রের জোয়ার ভাটার উপর। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কক্সবাজারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সেই রাতে হিমছড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এরপর আমরা (উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ) এই অঞ্চলের সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় কীভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বসি। সেখানে কলাতলী বাইপাস সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ নিয়ে আলোচনা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমরা বিষয়টি তুলে ধরি। তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল অলিকে দ্রুত বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করতে বলেন। তারা চলে যাওয়ার তিন মাস পর পূনরায় সপরিবারে কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল (অব:) অলি আহমদ। সেসময় তিনি সমুদ্রের তীর ধরে টেকনাফ যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করলে তাঁকে নিয়ে আমরা সৈকত ধরে টেকনাফের দিকে রওয়ানা দিই। কিন্তু রেজু খালের মোহনায় গিয়ে আমরা আটকে পড়ি। আসলে খালটির পানির গভীরতা বেশি থাকায় চরম ভাটার সময় ছাড়া জীপ নিয়ে ওপারে যাওয়া যেত না। বিষয়টি কর্ণেল অলিকে বেশ আহত করে। সেসময় তিনি অন্য এলাকার জন্য বরাদ্দকৃত একটি ব্রীজ জরুরীভিত্তিতে রামু-উখিয়ার সীমান্তবর্তী রেজু খালের উপর স্থাপনের নির্দেশ দেন। এরপর সৈকত ধরে অনেক কষ্টে মালামাল নিয়ে ব্রীজটি নির্মাণ করা হয়। সেসাথে ব্রীজের সাথে সংযোগ সড়কও নির্মাণ করা হয়। ফলে এই ব্রীজ ব্যবহার করে সমুদ্র সৈকতের প্রাকৃতিক পথে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনে। এদিকে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি মেরিন ড্রাইভ এবং কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ডাবল লেনে উন্নীত করার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদকালে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা গেলেও মেরিন ড্রাইভের কাজ ছিল অনেক বাকী। আমরা কেবল রেজু ব্রীজ পর্যন্ত একটি ইটের রাস্তা নির্মাণে সক্ষম হই। কিন্তু ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যোগাযোগ মন্ত্রী হলে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পে অর্থ সংস্থান বন্ধ করে দেয়। পরে ২০০১ সালে পূনরায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পে আবারো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই বরাদ্দ পেয়ে দ্রুত গতিতে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে মেরিন ড্রাইভের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ। আমাদের আমলে আমরা ইনানী পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। তবে বাকী রাস্তার এলাইমেন্ট ও আর্থওয়ার্কের কাজ সম্পন্ন করা গেলেও সময়াভাবে প্রকল্পটি পুরোপুরি সম্পন্ন করা যায়নি। কিন্তু বিষয়টি আমরা আগেই বুঝতে পেরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিকল্প সড়কে ইনানী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভের কাজও এগিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ পূনরায় ক্ষমতায় এলে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য কোন অর্থ বরাদ্দ দেননি। ফলে প্রকল্পটি চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবে ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হলে তিনি মেরিন ড্রাইভে অর্থ বরাদ্দ দেন এবং দ্রুত টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের কাজ সম্পন্ন করেন। এজন্য আওয়ামীলীগ সরকার তথা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আমি আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। আমি মনে করি, দেশের স্বার্থে এক সরকারের আমলে গৃহীত প্রকল্প অন্য সরকারের বাতিল করা উচিৎ নয়। দেশের স্বার্থে যেন আমরা সকলেই এই বিশ্বাস ধারণ করতে পারি। আর এভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।
-লেখক , সাবেক এমপি ও কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি ।